জর্ডানে আসলে কী ঘটেছিল বিউটির?

‘আমি চাই আমার আগে বিউটি মরুক’—এমন অলক্ষুনে প্রত্যাশা ৩০ বছর বয়সী বিউটিরই মায়ের। একজন মা কতটা বুকচাপা কষ্ট নিয়ে এমন কথা বলেন, তা শুধু মা রাবেয়া বেগমই জানেন। রাবেয়া বললেন, ‘বাড়ি বাড়ি তালাশ কইরা বিউটিরে খুঁইজ্যা আনি। আমারে হায়রে বকা দেয়, তারপরও ভাত বাইড়া দিই। আমি না থাকলে বিউটিরে কে দেখব? তাই মা হইয়াও চাই, আমার আগে বিউটি মরুক। না হইলে ওর যে কষ্ট হইব, তা চিন্তা কইরাই পাগল হইয়া যাই।’

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার আজিমপুর গ্রামের বিউটি আক্তার বিদেশফেরত নারী শ্রমিক। দু–তিন বছর আগে জর্ডান থেকে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন। এখন সারাক্ষণই আবোলতাবোল বকেন। মানুষকে গালি দেন। বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। তাই বিউটির মা শিকল দিয়ে মেয়েকে বেঁধে রাখেন। পায়ের শিকল গলায় ঝুলিয়ে তালা দিয়ে দেন। শরীরে শিকল থাকলে আশপাশ ঘুরেই বিউটি বাড়ি ফেরেন। তবে পুরো শিকল খুলে দিলে অনেক দূরে চলে যান। আর রাবেয়া যেদিন দূরে কোথাও যান, তখন মেয়েকে শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে যান।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর মুঠোফোনে যখন রাবেয়া বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন বিউটি অকথ্য ভাষায় প্রতিবেদককেও গালি দিতে থাকেন। রাবেয়া কথা বলতে বলতেই জানালেন, গায়ে শিকল নিয়েই বিউটি হাঁটা দিয়েছেন। ফোনে কথা শেষ করে ধরে বাড়ি আনতে হবে।

রাবেয়া জানালেন, বিউটি এমন ছিলেন না। এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন বিউটি। তবে এইচএসসি পরীক্ষায় একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এই বিউটির কাছেই গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে প্রাইভেট পড়তে আসত, সেই ছেলেমেয়েরা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

রাবেয়া বললেন, বিউটির বাবার তিন বিয়ে, সংসারে খরচ না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মা ও মেয়ের জীবন সব সময়ই সংগ্রাম করে কাটছে। বিউটির বিয়ে হয়েছিল, তবে বিউটির ছেলের বয়স যখন মাত্র আট বছর, তখন স্বামী মা ও ছেলেকে ফেলে চলে যান। সেই ছেলেকে রাবেয়া মানুষ করেছেন, তাঁর বয়স এখন ২০ বছর। এক ব্যক্তির গাড়ি চালান তিনি।

রাবেয়া বেগমের বিউটি ছাড়াও এক ছেলে আছেন। এই ছেলেও বিয়েথা করে আলাদা থাকেন। ছেলে মাকে কিছু হাতখরচ দেন, আর বিউটির ছেলের আয়ে বর্তমানে রাবেয়া, বিউটিসহ তিনজনের সংসার চলে।

রাবেয়া জানালেন, বিউটি লেবানন ছিলেন চার বছর। কাতার ছিলেন এক বছর। পরে জর্ডান থেকে ফেরেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। লেবানন থেকে বাড়িতে বাংলাদেশি টাকায় মাসে দু–তিন হাজার টাকা পাঠাতেন। সেই টাকায় বিউটির ছেলের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পর সঞ্চয় বলতে কিছু জমা হয়নি। কাতারে বাসার মালিক ভালো না হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় বিউটি একাধিক বাসা পাল্টান। সেখান থেকে টাকা পাঠাতে পারেননি। এরপর জর্ডান যান, সেখানে আসলে কী ঘটেছিল, তা কেউ জানে না। বিউটি যেসব আবোলতাবোল কথা বলেন, তা থেকেও স্পষ্ট কিছু বোঝা যায় না। তবে এমন কিছু হয়েছে, যার কারণেই বিউটি আজ মানসিক ভারসাম্যহীন।

রাবেয়া বললেন, ‘বিউটি বিভিন্ন বাড়িত গিয়া পাগলামি করলে মানুষ বিচার-সালিস বসায়। মানুষও গালি দেয় বিউটিরে। ওর ছেলে বোঝে, ওর মা পাগল। বিউটিও ছেলেরে আদর করে। আমার নিজের জীবন কাটছে নানান অশান্তিতে। আমার নিজেরই পাগল হইয়্যা যাওনের কথা ছিল, উল্টা বিউটি পাগল হইয়্যা ফিরল। এখন এই মেয়ে নিয়া আমার অবস্থা আরও কাহিল।’

রাবেয়া জানালেন, মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাননি। বিদেশ যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে বিউটির পাসপোর্টটি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন রাবেয়া। টাকার অভাবে মেয়ের চিকিৎসাও সেভাবে করতে পারেননি। রাবেয়া জানেন না, মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংগ্রামের শেষ কোথায়।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি সম্প্রতি কাজ করতে গিয়ে বিউটির খোঁজ পেয়েছে। এ কর্মসূচির পক্ষ থেকে বিউটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। ব্র্যাকের এ কর্মসূচির দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছরের জুন মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪৩ জন গৃহকর্মী নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশ থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। কর্মসূচির পক্ষ থেকে এই নারীদের জরুরি চিকিৎসা এবং চিকিৎসা শেষে স্বজনের হাতে তুলে দেওয়াসহ সাময়িক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিউটিদের মতো নারীর সংখ্যা বাড়ছে। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সাময়িক সহায়তা করা হচ্ছে। তবে এই নারীদের সুস্থ হওয়ার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কার্যক্রম। সরকার একা বা কোনো বেসরকারি সংগঠন একা এই নারীদের দায়িত্ব নিতে পারবে না। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। তবে এখন পর্যন্ত সে ধরনের উদ্যোগ, কাঠামো গড়ে ওঠেনি, নেই কোনো পরিকল্পনা। আমাদের কাজে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড মাঝেমধ্যে সহায়তা করে। তবে বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের পুনর্বাসনে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক টেকসই কাঠামো।’