রূপপুরে ৬ স্তরে দুর্নীতি, জড়িত ৩০ কর্মকর্তা বহাল

পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার অনিয়ম হয়েছে পদে পদে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাবনা ও রাজশাহীর পূর্ত বিভাগের ৩৪ জন প্রকৌশলী এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের একজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, একজন অবসরে গেছেন এবং দুই কর্মকর্তা অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) আছেন। বাকি ৩০ কর্মকর্তা এখনো স্বপদে বহাল।

এই ৩০ কর্মকর্তার বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা ও বিভাগীয় শাস্তির পরিকল্পনা নেই। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বিরুদ্ধে করণীয় ঠিক করতে চায় গণপূর্ত অধিদপ্তর। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত সোমবার এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে ৩৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।

জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছি। তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’ এ ঘটনায় পাবনা গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আর কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে তিনি জানান।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় ২০ ও ১৬ তলা ভবনের জন্য অস্বাভাবিক কেনাকাটা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে গত ১৯ মে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে একটি রিট আবেদনের পর হাইকোর্টের নির্দেশে গত সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দুটি প্রতিবেদন জমা দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

৬ স্তরে দুর্নীতি
এই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরে গণপূর্ত অধিদপ্তরে কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জোনভিত্তিক যে কেনাকাটা হয়ে থাকে, তার বার্ষিক একটি পরিকল্পনা থাকে। সে ক্ষেত্রে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না, স্থানীয় পর্যায়েই অনুমোদন করা যায়। এর সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতিটি কাজের মূল্য ৩০ কোটি টাকার নিচে হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন পড়েনি।

স্থানীয় পর্যায়ে কেনাকাটার ক্ষেত্রে গণপূর্তের কর্মকর্তাদের প্রথমে বছরভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদন করতে হয়। এরপর ব্যয় প্রাক্কলন, ব্যয় প্রাক্কলন পরীক্ষা ও সুপারিশের পর সর্বশেষ ধাপ হলো প্রাক্কলন অনুমোদন। যদি প্রকল্পের প্রাক্কলনে বা কেনাকাটার ব্যয় ধরার ক্ষেত্রে কোনো রকম ব্যত্যয় থাকে, নিয়ম না মানা হয়, তাহলে এসব স্তরের কোনো একটিতে তা ধরা পড়ে এবং সেটি সংশোধন করতে হয়। কিন্তু রূপপুরের ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় এসব স্তরে কোনো কর্মকর্তাই প্রশ্ন তোলেননি। এমনকি অস্বাভাবিক কেনাকাটার বিল যখন পরিশোধ হচ্ছে, তখনো এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। সে কারণে এসব স্তরের দায়িত্বরত সব কর্মকর্তাকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম (বর্তমানে পিআরএলে), গণপূর্ত রাজশাহী জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নজিবুর রহমান, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান (অবসরে), তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম জিল্লুর রহমান, পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেবাশীষ চন্দ্র সাহা।

>

১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার অনিয়ম
১৬৯ কোটি টাকার কাজ ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়
তদন্ত প্রতিবেদনে ৩৪ প্রকৌশলীর নাম
৩০ কর্মকর্তার বিষয়ে এখন পর্যন্ত শাস্তির পরিকল্পনা নেই

অস্বাভাবিক কেনাকাটার প্রাক্কলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁরা সবাই পাবনা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে প্রকল্পের অস্বাভাবিক কেনাকাটার সঙ্গে ৬ পর্যায়ে ৫৩ জন কর্মকর্তার নাম প্রতিবেদনে এসেছে। তবে একই কর্মকর্তার ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালনের কারণে একাধিক স্থানে একই ব্যক্তির নাম কয়েকবার এসেছে। সে হিসাবে অভিযুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৩৪।

দুর্নীতির অভিযোগে চারবার নাম এসেছে পাবনা গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের। তিনি এ প্রকল্পের প্রাক্কলন, বিল প্রদান, বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। এরপর এসেছে নজিবুর রহমানের নাম, তিনবার।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার মধ্যে চারটি ভবনের ১১৩ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ৫৬ কোটি টাকার বিল দেওয়া বাকি আছে। অথচ এর আগে ১৯ মে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, গত অক্টোবরে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি বিল পরিশোধ না করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদনে ঠিকাদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি ভবনে আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সাজিন এন্টারপ্রাইজ, মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়াম। সাজিনের সরবরাহ করা মালামাল সব থেকে নিম্নমানের। সাজিন একাই পেয়েছে ১৪৬ কোটি টাকার তিনটি কাজ।

প্রতিবেদনে আর মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী সরবরাহ করেনি। তবে জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘অপেক্ষাকৃত ভালো’।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গুরুত্ব অনুসারে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, যেসব ভবনে এখনো কেনাকাটা হয়নি, সেসব ভবনের কেনাকাটা প্রকৃত সরবরাহকারীদের কাছ থেকে নেওয়া, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি নিয়েছে যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, তা সরকারি কোষাগারে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, নতুন করে দরপত্র আহ্বান এবং বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নমানের পণ্য দিলে তা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের মূল্যতালিকা অনুযায়ী প্রাক্কলন করা হয়নি। অর্থাৎ বেশি দামে পণ্য কেনা হয়েছে। বিভিন্ন তলায় পণ্য তোলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক মূল্য ধরা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, রূপপুর প্রকল্পের ভবনে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। যদিও এর বাজারমূল্য সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। একইভাবে বিদেশি বিছানার চাদরের দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকা। এর বাজারমূল্য তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এভাবে ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলি, ওয়াশিং মেশিন, ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাব ও পণ্য ক্রয়ে অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়েছে।

এত বড় একটি প্রকল্পের কেনাকাটায় যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব মেগা প্রকল্পের কেনাকাটা ও আর্থিক হিসাব-নিকাশ জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত। কারণ ঋণনির্ভর এসব প্রকল্পের টাকা জনগণের করের অর্থে শোধ করা হবে। আর এসব প্রকল্পের সব ঝুঁকি শেষ পর্যন্ত জনগণকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, এমন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া কাম্য নয়, বরং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সহজ হবে।