লাখ টাকার খুনে জড়িত র‍্যাব সদস্য

মো. দুলা মিয়া
মো. দুলা মিয়া

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের পাট্টাশরীফ গ্রাম থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল মো. দুলা মিয়াকে। এ জন্য সাতজনকে এক লাখ টাকায় ভাড়া করেছিলেন র‍্যাবের এক সদস্য। ঢাকায় আনার পর ওই র‍্যাব সদস্য দুলা মিয়াকে (৪৫) নিজ হাতে খুন করে অন্যদের সহায়তায় ফেলে দেন বুড়িগঙ্গা নদীতে। চুনারুঘাট থানা-পুলিশ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

র‍্যাবের ওই সদস্যের নাম মো. সাদেক মিয়া। তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন ল্যান্সনায়েক, প্রেষণে ঢাকায় র‍্যাব-২-এ কর্মরত। তাঁর গ্রামের বাড়িও চুনারুঘাটের পাট্টাশরীফে। সম্পর্কে তিনি নিহত দুলা মিয়ার ভাতিজা। তাঁদের দুজনের বাড়ির সীমানা একই। তিন শতক জায়গা নিয়ে দুলা মিয়ার সঙ্গে সাদেকের বিরোধ ছিল। এরই জের ধরে দুলা মিয়াকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।

চুনারুঘাটের ৫ নম্বর শানখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, র‍্যাব সদস্য সাদেকের চাচার কাছ থেকে দুলা মিয়া তিন শতক জায়গা কিনেছিলেন। সাদেক এই জায়গা দাবি করলে দুলা মিয়া তা দেননি। জায়গা নিয়ে মামলা করলেও রায় পান দুলা মিয়া। এর আগে একবার সাদেক মিথ্যা মামলা দিয়ে দুলা মিয়াকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। তখন তাঁকে তিন মাস জেল খাটতে হয়েছিল।

চেয়ারম্যান জানান, দুলা মিয়া (৪৫) খুবই দরিদ্র। অন্যের জমিতে চাষ করেন। তাঁর পাঁচ কন্যাসন্তান রয়েছে, তাঁদের একজন প্রতিবন্ধী।

এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। একজন হলেন মাইক্রোবাসের চালক মো. ইউসুফ সর্দার এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. মামুন মিয়া। আদালতে দেওয়া এই দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে র‍্যাব সদস্য সাদেক মিয়ার পরিকল্পনায় দুলা মিয়াকে অপহরণ ও হত্যার পুরো বিষয়টি উঠে এসেছে।

গত ১৭ জুন সন্ধ্যায় দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় আনা হয়। ১৮ জুন দুপুরে রাজধানীর হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পাটের বস্তায় মোড়ানো এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই অজ্ঞাত লাশটিই দুলা মিয়ার বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁর স্বজনেরা।

>

তিন শতক জায়গা নিয়ে দুলা মিয়ার সঙ্গে সাদেকের বিরোধ
বিরোধের জেরে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়
অপহরণ ও হত্যায় অংশ নেন র‍্যাব সদস্য সাদেকসহ আটজন
মাইক্রোবাসচালক ও এক খুনি জবানবন্দি দিয়েছেন
র‍্যাব সদস্য সাদেককে হস্তান্তর করতে পুলিশ সুপারের চিঠি

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দুলা মিয়াকে অপহরণের পর তাঁর ছোট ভাই ইদু মিয়া চুনারুঘাট থানায় মামলা করেন। ঘটনা তদন্তে নামে চুনারুঘাট থানা-পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ধরে দুলা মিয়াকে যে মাইক্রোবাসে তুলে আনা হয়, সেটি একটি টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরা থেকে শনাক্ত করে তারা। এরপর গাড়ির নম্বর ধরে এর চালক ইউসুফ সর্দারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয় মামুন মিয়াকে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মো. মামুন মিয়া বলেছেন, তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এরই সূত্র ধরে বছরখানেক আগে র‍্যাব সদস্য সাদেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। গত ১৪ জুন সাদেক তাঁকে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ডেকে নিয়ে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেন। ১৬ জুন তাঁকে গাড়ি ভাড়াসহ অন্য খরচের জন্য ১৪ হাজার টাকা তুলে দেন। ১৭ জুন চালক ইউসুফসহ শামীম, বাদল, জামাল, জসিম, ওয়াহাবসহ সাতজন মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের কাছে র‍্যাবের ক্যাম্পে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি (মামুন) সেখানে গেলে সাদেক মিয়া বলেন, তাঁর ভাগিনা আফরাজ এলাকা থেকে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে সহায়তা করবে।

মামুন জানিয়েছেন, তাঁরা সাতজন মাইক্রোবাস নিয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছয়টার দিকে চুনারুঘাট পৌঁছান। সাদেকের কথা অনুযায়ী আফরাজ তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা আফরাজদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আফরাজ তাঁদের জানান দুলা মিয়া হলুদ লুঙ্গি, সাদা চেক শার্ট পরে টমটমে করে আসছেন। টমটম তাঁদের গাড়ির কাছাকাছি এলে জসিম, ওয়াহাব ও বাদল গাড়িটি থামান। নিজেদের ‘ডিফেন্সের লোক’ পরিচয় দিয়ে তাঁরা দুলা মিয়াকে গাড়িতে তোলেন। পানি খেতে চাইলে ঘুমের ওষুধ গুলিয়ে দুলা মিয়াকে খাইয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইউসুফ ও মামুন জানিয়েছেন, রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তাঁরা দুলা মিয়াকে নিয়ে ঢাকায় র‍্যাব ২ ক্যাম্পের সামনে পৌঁছান। ফোন পেয়ে সাদেক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের নিয়ে সিকদার মেডিকেলের পেছনে যান। সাদেক নির্দেশ দেন দুলা মিয়ার হাত-পা বাঁধতে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর ফলে দুলা মিয়ার শরীর এমনিতেই নিস্তেজ ছিল। জোর খাটানোর শক্তি পাননি। এরপর সাদেক নিজে মাছ মারার জাল দিয়ে দুলা মিয়ার গলায় প্যাঁচ দেন, নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর অন্যরা মিলে লাশটি বস্তায় ভরে সেটি বেড়িবাঁধের নিচে নদীতে ফেলে দেন।

দুলা মিয়াকে হত্যার পর মামুনকে আরও টাকা দেন সাদেক। এর মধ্যে গাড়িচালক ইউসুফকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা মামুনসহ অন্যরা ভাগ করে নেন।

এ ঘটনার পর হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা গত সোমবার র‍্যাব-২-এর অধিনায়কের কাছে চিঠি পাঠান। এতে তিনি বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাদেককে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‍্যাব ২-এর অধিনায়ক মো. আশিক বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার তাঁকে বিষয়টি জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে মঙ্গলবার রাতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল হকের উপস্থিতিতে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে সাদেক মিয়াকে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।