সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ ৩১ জুলাই

ফেণীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে আজ বুধবার আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ছবি: আসাদুজ্জামান
ফেণীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে আজ বুধবার আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ছবি: আসাদুজ্জামান

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। এর মধ্য দিয়ে তাঁর বিচার শুরু হলো। আগামী ৩১ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করা হয়েছে।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম মোয়াজ্জেম হোসেনকে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আপনি কী দোষী?’ জবাবে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমি নির্দোষ।’ সাইবার ট্রাইব্যুনালের পেশকার শামীম তখন জানিয়ে দেন, আগামী ৩১ জুলাই এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে গত ১৫ এপ্রিল মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত তা আমলে নিয়ে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন। এর ২০ দিনের মাথায় গত ১৬ জুন মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

ভিডিও করার কথা স্বীকার
মোয়াজ্জেমকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে সকালে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। বেলা ২টার দিকে মোয়াজ্জেমকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ আগেই মোয়াজ্জেমকে মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে লিখিত আবেদন করেন। মোয়াজ্জেমকে মামলা থেকে কেন অব্যাহতি চান সেই যুক্তি তুলে ধরেন ফারুক। আদালতকে ফারুক বলেন, মামলা করতে গেলে লাগবে সময়, স্থান ও ঘটনা। মামলা করেছেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। কিন্তু মামলার কোথাও বলা হয়নি, কখন এই ঘটনা ঘটেছে। আইনজীবী সায়েদুল হক এই মামলা করতে পারেন না। আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারবেন ভুক্তভোগী কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সায়েদুল হক ভুক্তভোগী নুসরাতের পরিবারের কেউ নন।

সায়েদুল হক কেন এই মামলা করতে পারেন না—এর যুক্তি হিসেবে ফারুক আদালতকে আরও বলেন, সায়েদুল হক থানায় মামলা করতে যাননি। কিংবা থানা তাঁকে ফেরত দিয়েছে এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি। মামলা করতে গেলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। আদালতের অনুমতি নিয়ে সায়েদুল হক মামলা করেননি। তবে ফারুক আহম্মেদ আদালতের কাছে স্বীকার করেন, মামলার তদন্তের প্রয়োজনে নুসরাতের ভিডিও রেকর্ড করেন। তবে তা একজন নারী কনস্টেবলের উপস্থিতিতে।

নুসরাতের ভিডিও রেকর্ড করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ফারুক বলেন, ফেনীর সোনাগাজীর স্থানীয় মেয়র ও একজন পুলিশ কনস্টেবল জবানবন্দিতে বলেছেন যে নুসরাতের ভিডিও রেকর্ড করার সময় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের আচরণ ভালো ছিল। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের কথা তুলে ধরে ফারুক বলেন, শ্লীলতাহানির শিকার একজন ভুক্তভোগীর আইনি যত অধিকার তা সবই দিয়েছেন মোয়াজ্জেম। স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তুলেছেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েক শ মাদ্রাসা ছাত্র থানা ঘেরাও করে। এ সময় স্থানীয় সাংবাদিকেরা তাঁর কক্ষে আসেন। নানা বিষয় তাঁর কাছে জানতে চান।

নুসরাতের ভিডিও করার কথা আদালতের কাছে স্বীকার করে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আদালতে দাবি করেন, মোয়াজ্জেম তাঁর মুঠোফোন রেখে বাথরুমে যান। এমন সময় স্থানীয় সাংবাদিক মোয়াজ্জেমের মোবাইল ফোন থেকে নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা ভিডিও চুরি করেন। নুসরাতের ওই ভিডিও যখন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচার হয়, তখন মোয়াজ্জেম থানায় একটা জিডিও করেন। অর্থাৎ, মোয়াজ্জেম নুসরাতের কোনো ভিডিও ফেসবুক, টুইটার কিংবা কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেননি।

মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুকের এই কথা শুনে আদালত তখন জানতে চান, কোন আইন বলে মোয়াজ্জেম নুসরাতের ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন? জবাবে ফারুক বলেন, অপরাধের তদন্তের প্রয়োজনে নুসরাতের বক্তব্য রেকর্ড করেন মোয়াজ্জেম। ফারুক আহম্মেদের বক্তব্য শেষ হলে পিপি নজরুল ইসলাম আদালতকে বলেন, আসামির আইনজীবীরা স্বীকার করছেন যে নুসরাতের ভিডিও ওসি মোয়াজ্জেম রেকর্ড করেছিলেন। সেই ভিডিও ইউটিউবে দেখেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী, কোনো ভুক্তভোগীর নাম, পরিচয়, ছবি প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যার মোবাইল তার দায়িত্ব রক্ষণাবেক্ষণ করার। মোয়াজ্জেমের আইনজীবীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, তিনি বাথরুমে গেলে অন্য কেউ নুসরাতের ভিডিও চুরি করে নিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। এটা খোঁড়া যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

পিপি নজরুল ইসলাম আদালতকে জানান, পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে নুসরাতের ভিডিও রেকর্ড করে তা ছেড়ে দেওয়া হয়। মোয়াজ্জেম হোসেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারার অপরাধ করেছেন। নুসরাতের ভিডিও প্রকাশের পর সারা বিশ্ব তা দেখেছে। এই ভিডিও দেখার পর মানুষ ফুঁসে উঠেছে, নেতিবাচক মন্তব্য করছে। আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে মোয়াজ্জেম হোসেনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন খারিজ করে দেন।

নুসরাত জাহানকে গত ৬ এপ্রিল পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেন তাঁর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ১০ এপ্রিল সে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এর ১০ দিন আগে নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে সোনাগাজী থানায় যান। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ আনা হয় মামলায়।