প্রাকৃতিক কীটনাশক ও জৈব সার নিয়ে মজিদের যুদ্ধ

নিজের সবজি বাগানে আবদুল মজিদ সরদার। সম্প্রতি যশোরের কেশবপুরের সন্যাসগাছা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
নিজের সবজি বাগানে আবদুল মজিদ সরদার। সম্প্রতি যশোরের কেশবপুরের সন্যাসগাছা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

কয়েক ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করেন কীটনাশক। কচুরিপানা, গোবর ও পাতা–লতা পচিয়ে বানান জৈব সার। এ দুটিই তাঁর মূল হাতিয়ার। এ নিয়েই ‘যুদ্ধে’ নামেন রোজ। মাঠের পর মাঠ চষে বেড়ান। চাষিদের বোঝান, রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ, নিরাপদ খাদ্যের চিন্তা ছড়িয়ে দেন তিনি কৃষক থেকে কৃষকের মধ্যে।

এক যুগ ধরে কাজটি করছেন তিনি। নিজ বাড়ির আঙিনায় সবজি ও ফলের আদর্শ এক বাগান গড়েছেন। তাঁর ব্যতিক্রমী এই চাষবাস দেখতে লোকজন আসেন দূরদূরান্ত থেকে, পরামর্শ নেন। ভেজাল পণ্য, ভেজাল খাবার নিয়ে মানুষ যখন চিন্তিত, তখন নিরাপদ খাদ্যের এই চিন্তা নতুন পথ দেখায়। তাঁর দেখানো পথ ধরে সাফল্যও পেয়েছেন অনেকে। নতুন পথের এই দিশারি আবদুল মজিদ সরদার (৬২)। বাড়ি তাঁর যশোরের কেশবপুর উপজেলার সন্যাসগাছা গ্রামে।

শুরুর কথা
উচ্চমাধ্যমিক পাস করে জীবিকার তাগিদে চলে যান ঢাকায়। ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখেননি। ফিরে আসেন গ্রামে। চাষাবাদ শুরু করেন। ২০০২ সাল থেকে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি তাঁর মাথায় ঢোকে। জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ শুরু করেন। একসময় প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে সেই নির্যাস থেকে কীটনাশক তৈরি করে ফেলেন। নিজে ব্যবহার করে ভালো ফল পান। আশপাশের কৃষকেরা শুরুতে তাঁকে পাগল ঠাওরাতে লাগলেন। কিন্তু তিনি দমার পাত্র নন। একে লড়াই মনে করে চালিয়ে গেছেন নিরাপদ খাদ্যের সংগ্রাম। এখন সন্যাসগাছা ও তার আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা উল্টো তাঁর কাছে আসেন জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে।

সন্যাসগাছা গ্রামের কৃষক কামরুল ফকির বলেন, মজিদ ভাইয়ের পরামর্শে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করে সফল হয়েছেন তিনি। কৃষক বেল্লাল হোসেনের ভাষ্য, আবদুল মজিদের পরামর্শে ধনে চাষে জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে গত বছর ভালো ফলন পেয়েছেন।

আবদুল মজিদের কাজ-কারবার সম্পর্কে কৃষি বিভাগও জানে। কৃষি নিয়ে নানা সভা-সেমিনারে ডাকা হয় তাঁকে। সেখানে তিনি কৃষকদের জৈব পদ্ধতির চাষ তথা নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে পরামর্শ দেন। কেশবপুর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তপন কুমার দে বলেন, আবদুল মজিদ একজন কৃষিপ্রেমী মানুষ। তাঁর বানানো জৈব সার ব্যবহারে ফলন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর আঙিনার সবজি ও ফলের বাগান এলাকার মধ্যে আদর্শ বাগান।

কীটনাশক ও জৈব সার তৈরির প্রণালি
কীটনাশক বানানোর জন্য আড়াই ফুট লম্বা প্লাস্টিকের ড্রাম নিতে হবে। ভেতরে ৪০-৫০টি মেহগনির ফল টুকরো টুকরো করে মাড়াই করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। দেড় কেজি নিম ফল, দুই কেজি নিমপাতা, আধা কেজি নিমের ছাল ড্রামের ভেতরে দিতে হবে। আতাগাছের পাতা, মূল এবং ছাল, বিষকাঁটালিগাছ, ধুতরার পাতা, নিম ফল, গাঁদা ফুলের পাতা, দূর্বা, গরুর মূত্র, লাল বিশালিগাছ পিষে ওই ড্রামে দিতে হবে। মিশ্রণটি ১৫ থেকে ২০ দিন পচতে দিতে হবে। ড্রামের মুখ পলিথিন দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন পাত্রটি বায়ুশূন্য হয়। তারপর পচে যাওয়া উপাদান থেকে রস বা নির্যাস বের করে নিতে হবে। সুতি কাপড় দিয়ে আরও কয়েকবার ছেঁকে নিলেই এটি ফসলের ওপর স্প্রে করার উপযোগী হবে। একটি ড্রাম থেকে ৩৫ লিটারের মতো কীটনাশক পাওয়া যায়। ১ বিঘা জমিতে আড়াই লিটার কীটনাশক ছিটালেই চলে।

জৈব সার তৈরির প্রণালিটি সহজ। গোবর ও ফসলের ফেলে দেওয়া অংশ যেমন বাঁধাকপির পাতা, ফুলকপির ডাঁটার অংশ, রাস্তার পাশে জন্মানো লতাজাতীয় গাছ ও ফসলের বর্জ্য, কলাগাছের পাতা একসঙ্গে ৮ হাত দৈর্ঘ্য, ৬ হাত প্রস্থ ও ৪ ফুট গভীর একটি গর্তে ১০-১২ দিন পচাতে হবে। গর্তটি বায়ুশূন্য হওয়ার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এরপর গর্ত থেকে মিশ্রিত উপাদান তুলে ৪-৫ দিন রোদে শুকাতে হবে। পরে দলাগুলো ভেঙে নেট দিয়ে ছেঁকে জমিতে ব্যবহার করতে হবে। ওই পরিমাণ গর্ত থেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ মণ জৈব সার পাওয়া যায়। ১ বিঘা জমিতে ২১ কেজির মতো জৈব সার হলেই চলে।

পারিবারিক বাগান
মজিদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছেন ফল ও সবজির চমৎকার একটি বাগান। এই বাগান থেকে পাওয়া সবজি নিজে খান এবং কিছু বিক্রি করেন। তাঁর সবজিবাগানে রয়েছে স্ট্রবেরি, টমেটো, আলু, লেটুসপাতা, ব্রকলি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ড্রাগন রসুন, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, থানকুনি ও সরিষা। বাগানটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। তাঁর পরামর্শ নিয়ে অনেকে এই আদলে বাগান করছেন।

মজিদ তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির জোরে পরিচিত হয়ে উঠছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার খালেদ মো. আরাফাত বলেন, আবদুল মজিদের আবিষ্কৃত জৈব কৃষি সাফল্যের মুখ দেখেছে। অনেক কৃষক তা গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তফা কামাল বলেন, মজিদ ভাইয়ের জৈব সার ও কীটনাশক খুবই ভালো। তাঁর উপাদান ব্যবহার করে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও বেগুন চাষ করে তিনি সাফল্য পেয়েছেন।

মজিদের স্বপ্ন
‘আবদুল মজিদের একটি গবেষণার মন আছে। তিনি ফোন করেন তাঁর চিন্তা ও ভাবনা বিনিময় করেন। তাঁর উদ্যোগটি ভালো।’ বলছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রো টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক মনিরুল ইসলাম।

কিন্তু কৃষির জন্য সব সময় ভাবলেও অর্থাভাবে অনেক কাজ করে উঠতে পারেন না মজিদ। তাঁর ১ একর জমির ওপরে ফসলের খেত, সবজিবাগান, দুটি পুকুর থেকে যা পান তা দিয়ে সংসার কোনোরকমে চলে। আবদুল মজিদ বলেন, আর্থিক কষ্টের কারণে তাঁর ভাবনার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন না। একটি অর্গানিক ফার্ম করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

গাজীপুরের জয়দেবপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দীনও মজিদ সম্পর্কে জানেন। তাঁর ভাষ্য, ‘সব ধরনের অর্গানিক কর্মকাণ্ডকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি। বর্তমান সরকার একে গুরুত্বসহকারে দেখছে। আবদুল মজিদকে আমি কারিগরি সহায়তা দিই। তাঁর বিকল্প বালাইনাশনক বা কীটনাশক উদ্ভাবন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।’