চুনোপুঁটি ধরব, বড় মাছও ধরব: ইকবাল মাহমুদ

দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২০ জুলাই। ছবি: দীপু মালাকার
দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২০ জুলাই। ছবি: দীপু মালাকার

একই অনুষ্ঠান উপস্থিত আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। বিচারপতি নিজামুল হক দুদক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, বড় লোকেরাই সব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। কেবল চুঁনোপুটির পেছনে ছুটলে হবে না। চুনোপুঁটি বাদ দিয়ে বড় বড় রুই কাতলা, বোয়াল ধরতে হবে।

এর জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘চুনোপুঁটি ধরা হচ্ছে, তা অস্বীকার করছি না। ছোটগাছ উপড়ে ফেলা যত সহজ, বড় গাছ উপড়ে ফেলা তত সহজ নয়। তাই বলে বড় গাছ যে ধরছি না, তা কিন্তু নয়। আমরা চুনোপুঁটিও ধরব, বড় মাছও ধরব।’

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান এই কথা বলেন।

সেমিনারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আইন করে, সাজা দিয়ে কখনো দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। প্রতিদিন দেশে ছয়টি শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। আমাদের মানবতা সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। সামাজিক ন্যায়বিচার যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কোন বিচারালয় ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে না। সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গাটা বাংলাদেশে ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা যে কত বড় বিপদ সংকেত তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। এটা বড় অশনিসংকেত।’

সক্ষমতার অভাব আছে
বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করার আহবান জানান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। সমালোচনা করেন। তবে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা হলে পরে সবারই লাভ। সমালোচনাটা একটা খোরাক।’

সাবেক আইনমন্ত্রী সাংসদ আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সচিবালয়, ওয়াসা অফিস, রাজউকে দুর্নীতি হচ্ছে। দুদককে তার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।’

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। ২০০৪ সাল থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন শুরু হলেও একটা মাত্রায় উঠতে গেলে এক কমিশন, দুই কমিশন, তিন কমিশন, চার কমিশন, পাঁচ কমিশনে সম্ভব না। কারণ সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’

দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের পক্ষ থেকে স্কুলে স্কুলে সততা সংঘ করার তথ্য তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধান, তদন্ত শেষ হচ্ছে না। বিধিও পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৫ দিনের জায়গায় ৪৫ দিন করা হয়েছে। ৩০ দিনের জায়গায় ১৮০ দিন করা হয়েছে। তারপরও নির্ধারিত সময় শেষ হচ্ছে না। নানা রকম অজুহাত দেখানো হয়।

ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের তো অজুহাত দেওয়ার সক্ষমতা অনেক বেশি। আমরা যারা বাংলাদেশের মানুষ তাদের অজুহাত দেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি।’

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ‘দুদক ভালো কাজ করছে, যদি আরও ভালো কাজ করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আকাশ থেকে উড়ে আসেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনে যারা কাজ করেন তারা কিন্তু বিদেশ থেকেও আসেননি। আমরা সবাই এই সমাজের মানুষ। আমরা এই সমাজেরই অংশ। সমাজের অন্য জায়গায় যা হয় আমার এখানে যে তা হয় না তা বলব না।’

আলোচনা সভায় দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘প্রায় বলা হয়, সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে কিছুই করা হয় না। কিন্তু আমার জানামতে সরকার দলীয় রয়েছেন ১০ থেকে ১৫ জন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে একদলে আছেন ১৫ জন, আরেক দলে রয়েছেন ১২ জন। ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এমন আছেন ২৫ জন। সচিব থেকে যুগ্ম সচিব আছেন ১৫ জন।’

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ‘যদি দেখা যায় আসামি কম ক্ষমতা সম্পন্ন অথবা বিরোধী দলের সমর্থক বা তাদের লোক, তাহলে খুব দ্রুতই বিচার হয়ে যায়। আমরা চাই, সমস্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কুইক কাজটা করা দরকার। যেন মানুষের মনে ধারণা আসে, অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না।’

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা আছে। ব্যর্থতা কাটানোর জন্য কী করা যায় সেটা আপনারা বলবেন। সমালোচনা করেন। সমস্যার সমাধান কী হবে সেটা যদি বলেন। সবার সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।সামাজিক আন্দোলন দানা না বাধলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়।’

দুদককে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আহবান জানান সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। তিনি বলেন, দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। তাঁদের বেতন বাড়াতে হবে।
বিচার বিভাগের জন্য বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে মন্তব্য করেন আবদুল মতিন খসরু। ছোট বেলা থেকে শিশুদের মনে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার ওপর জোর দেন বক্তারা।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম বলেন, আমাদের স্কুল থেকে শুরু করতে হবে। দুর্নীতির বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নৈতিকতা যদি সমাজে ফিরিয়ে না আনা যায়, তাহলে আইন দিয়ে, সাজা দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা থাকলেও দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। আমাদের সামাজিক আন্দোলন করতে হবে।

দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: আসাদুজ্জামান
দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: আসাদুজ্জামান

সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ফৌজদারি আইনে সরল বিশ্বাসে অপরাধ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না । তবে তিনি এ-ও বলেন, সরল বিশ্বাস বিষয়টি প্রমাণিত হতে হবে ।
সরল বিশ্বাসের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার উত্তর একেবারই সহজ। ডিসি সম্মেলনের পরে একটি প্রশ্নের জবাবে আমি যে উত্তরটা দিয়েছি তার ভিডিও ক্লিপ আপনাদের কাছে আছে। আমি সেখানে দুর্নীতির কোনো শব্দ সেখানে উচ্চারণ করিনি। আপনারা দেখে থাকতে পারেন। দুর্নীতি শব্দ কীভাবে আসলে জানি না। যারা দুর্নীতি শব্দ এনেছেন এটা তাদের দায়। সেটা আমার দায় না মোটেও। আমি কোনো ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত নই।’

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘ক্ষমা চাওয়ার মত সৎ সাহস বা মানসিক শক্তি আমার আছে। আমি যদি কোন ভুল করি তাহলে জাতির কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে আমার কোন লজ্জা বা কুণ্ঠাবোধ নেই।’
দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন আইনজীবী এম এস আজিম।