যমুনার চরে নাওভানুদের বেঁচে থাকা

বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ভাঙ্গুরগাছা চরের মানুষের বাড়িঘর। বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই। ছবি: খোরশেদ আলম
বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ভাঙ্গুরগাছা চরের মানুষের বাড়িঘর। বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই। ছবি: খোরশেদ আলম

আট দিন ধরে পানিবন্দী। বসতঘরে বুকপানি। ঘরের ভেতরে কাঠের ফালি আর বাঁশ দিয়ে উঁচু মাচা তৈরি সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন নাওভানু বেগম (৪৮)। উত্তাল যমুনা। এ ঘর তাঁর নিজের নয়। যমুনার পানির ঢলে নিজের বাড়ি ডুবে গেছে। দূরের এক পরিচিত মানুষের প্রায় ডুবে যাওয়া এক ঘরে উঠেছেন। সেখান থেকে কলার ভেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নাওভানু। সঙ্গে স্বামী কবির আলী শেখ।

চর দলিকায় ভেসে যাওয়া ঘরের পাশে ডিঙিতে গত বৃহস্পতিবার কথা হয় নাওভানুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাতটা দিন ধরে পানিত ভাসিচ্চি। ঘরত চাল, ডাল কিছুই নাই। বিস্কুট মুড়ি খায়্যা দিন যাচ্চে। খাবার পানি নাই। বানের পানি খাচ্চি। কিছু ধান ছিল উচা মাচানত রাখচিলাম। ঘরের ভিতর মাচানত রাত কাটাচি। রাততও ঘরডা ছিল। সকালে চোখের সামনে বানের ঢল নিমেষেই ঘরের সঙ্গে গোটা সংসারডা ভাসে লিয়ে গেল।'

শুধু নাওভানু নয়, যমুনার ঢলে গত বৃহস্পতিবার ও বুধবার ভেসে গেছে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের ভাঙ্গুরগাছা ও চর দলিকার দুই শতাধিক বসতঘর। বসতঘরের সঙ্গে ভেসে গেছে চাল-ডাল, বিছানা-বালিশসহ সবকিছু। নাওভানুর বাড়ি এই চর দলিকায়।

চর দলিকার চেয়েও করুণ চিত্র পাশের ভাঙ্গুরগাছা চরের। কদিন আগেও যেখানে ছিল লোকালয়, ছিল ১৪০টি পরিবারের বসবাস। এক নিমেষেই ভেসে গেছে সব বাড়িঘর, বসতভিটা, লোকালয়। সেখানে এখন অথই পানি, নেই লোকালয়ের কোনো চিহ্ন।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থান চর দলিকার। চারদিকে নদী মাঝখানে মানুষের বসতি। এর কয়েক কিলোমিটার অদূরে জামালপুরের ইসলামপুর। নদীর পূর্ব পারে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলা। প্রায় আধা কিলোমিটার উত্তর–দক্ষিণ লম্বা এই চরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। বিদ্যালয়ও ডুবে গেছে যমুনার ঢলে।

যমুনার স্রোতে ভেসে গেছে চর দলিকার দিনমজুর আবদুল মান্নানের বসতঘর। একটা কলাগাছের ভেলায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানকে কয়েক দিন আগে রেখে এসেছেন পাশের মানিকদাইর চরে ।
আবদুল মান্নান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী। ঘরের ভেতর কোমরপানি। মঙ্গলবার সকালে প্রমত্তা নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি। দুই দিন ধরে অনাহারে। সকালে কলার ভেলায় পাশের বাড়িতে গিয়ে শুকনো খাবার চেয়ে খেয়েছেন। আশায় আছেন বাপ-দাদার ভিটে আবার জেগে উঠবে।

চর দলিকায় গিয়ে দেখা গেল, চরের অধিকাংশ বাসিন্দা নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ ডুবে যাওয়া ঘরের টিনের চালা নৌকায় তুলে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউবা হাঁস-মুরগি, ছোট ছোট আসবাব নৌকায় তুলে যাযাবরের মতো নদীতে ভেসে রয়েছেন।

নৌকার ওপর বসে নিজের ভেসে যাওয়া ঘরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মর্জিনা বেগম। ছয় সন্তানের জননী মর্জিনা বলেন, তাঁদের ঘরে প্রায় ৩০ মণ ধান ছিল। শুকনো মরিচ ছিল ৮ থেকে ১০ মণ। তাঁর তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুটি সন্তানকে গত রোববার রাতে নৌকায় করে হাটবাড়ী চরে আত্মীয়ের বাড়িতে রাখতে গিয়েছিলেন। সোমবার সকালে তিনি ও তাঁর স্বামী আবু সাইদ বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু নদী থেকে রক্ষা করতে পারেননি তাঁদের বাড়ি। জানালেন, পানির স্রোতের কাছে মানুষের শক্তির কোনো দাম নেই। স্রোত কারও কথা শোনে না।

ওই চরের এবাদুল হকের স্ত্রী সোনাভান বুকপানিতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জানালেন, তাঁরও একটি ঘর নদী টেনে নিয়ে গেছে। গোলাপী বেগম জানান, বাড়িঘর হারিয়ে দুই দিন ধরে তিনি রান্নার সংকটে না খেয়ে রয়েছেন। বাবর আলী বলেন, অন্তত ১৪০টি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী লালভানু বলেন, তাঁদের দুটি বাড়ির মধ্যে একটি ভেসে গেছে। আরেকটিও রক্ষা করা কঠিন হবে।
চর দলিকায় সর্বস্ব হারানো বানভাসি মানুষজনকে সান্ত্বনা দিতে দেখা গেল স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত আলীকে। তিনি জানালেন, এই দুর্গম চরে প্রায় ২৫০ পরিবারের ১ হাজার মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে অর্ধশত পরিবারের বসতঘর ঢলের পানিতে ভেসে গেছে।
চর দলিকা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে ভাঙ্গুরগাছা চর। আধা বর্গকিলোমিটার এই চরে বসবাস ছিল ১৪০ পরিবারের প্রায় ৭০০ মানুষের। এই চরের চারদিকেই যমুনা নদী। থইথই করছে পানি। পাঁচ–ছয়টি বসতঘর ছাড়া সবই তলিয়ে গেছে, বানের তোড়ে ভেসে গেছে। তলিয়ে যাওয়া বসতঘরের টিনের চালা খুলে নৌকায় তুলে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন কয়েকজন।
ভাঙ্গুরগাছা চরে কথা হয় আরজ আলী শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন আর ঘরের আশা নেই। সব নদীর নিয়ে গেছে। পৈতৃক ভিটা। ছাড়তে ইচ্ছে করে না। এই কারণে নৌকার ওপর আশ্রয় নিয়ে আছি। নদীর পানি কমলে আবারও এখানে ঘর তৈরি করব।’
একই চরের বাসিন্দা আবদুল খালেক ও সোহেল রানা তাঁদের বাড়ির টিনের চালা নৌকায় তুলে মানিকদাইর চরে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বলেন, ‘শত কষ্টেও এখানে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িঘর তো স্রোতে ভেসে গেছে। ধান-চাল-ডাল আসবাব সব নদীর মধ্যে। ত্রাণের চাল পেয়েছি। কিন্তু রান্না করার কোনো উপায় নেই। এ কারণে আশপাশের কোনো চরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছি। অন্তত ছেলেমেয়ে আর গরু-বাছুর তো বাঁচাতে হবে।’

৩৬ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি কমেছে ১৪ সেন্টিমিটার
বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি ৩৬ ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার কমে সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে আজ শনিবার দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ১১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে এখনো পানিবন্দী সোয়া লাখ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, যমুনা নদীর মথুরাপাড়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। শুক্রবার সকাল ছয়টায় পানিপ্রবাহ ছিল ১৭ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপৎসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপরে। আজ দুপুর ১২টায় পানি নেমে এসেছে ১৭ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটারে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নের ১২৯টি গ্রামের প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৩১ হাজার ৫৮৫। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ১৪৫টি বসতবাড়ি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ছয় শতাধিক ঘরবাড়ি। বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। ৮৯টি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ জলমগ্ন হওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর। বন্যায় প্রায় ১০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে কৃষকের জাগ দেওয়া কয়েক হাজার একর জমির পাট। বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে ৪৩ কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বানের ঢলে প্রায় ৭৪ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এতে খামারিদের পৌনে ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ। যমুনার ঢলে ভেসে গেছে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চর দলিকা, চর ভাঙ্গুরগাছা, সুজনেরপাড়া, আউচারপাড়া গ্রামের কয়েক শ বসতঘর। এসব চরে বসবাসকারী মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী বলেন, দুর্গতদের জন্য আজ পর্যন্ত ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৪৬৭ মেট্রিক চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।