বন্যা হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী

বন্যার পানিতে জামালপুরে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব তলিয়ে গেছে। নৌকা নিয়ে চলাচল করছে মানুষ। গতকাল সকালে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে।  ছবি: প্রথম আলো
বন্যার পানিতে জামালপুরে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব তলিয়ে গেছে। নৌকা নিয়ে চলাচল করছে মানুষ। গতকাল সকালে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো

দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইতিমধ্যে রাজধানীর চারপাশের জেলাগুলোতে বন্যার পানি চলে এসেছে। তবে দু–এক দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত বেড়ে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে এসব কথা বলা হয়েছে।

বন্যা ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে পানি সহজে নামবে না। কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি যমুনা হয়ে এখন দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত চলে এসেছে। গতকাল রোববার থেকে পদ্মাপারের জেলা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীতে বন্যার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও বাড়ছে। ওই নদের তীরবর্তী জেলা শেরপুরে ইতিমধ্যে বন্যা শুরু হয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ময়মনসিংহ জেলায় বন্যার পানি চলে আসতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ ও ওষুধের মজুত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মূলত উজান থেকে আসা ঢল ও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে বছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে দুই–তিন দফায় বন্যা হয়। এসব বন্যা ৩ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। এবার জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কুড়িগ্রামে বন্যা শুরু হয়ে তা এখন রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে পৌঁছেছে। দুই সপ্তাহ পার হলেও সেই পানি নামেনি, বরং প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গত শুক্রবার থেকে পদ্মা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পানিও বাড়ছে।

প্রথম আলোপ্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী গতকাল বন্যায় দেশের পাঁচটি জেলায় ছয়জন মারা গেছে। বাঁধ ভেঙে ও উপচে প্লাবিত হয়েছে মাদারীপুর, রাজবাড়ী, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর জেলার নতুন নতুন এলাকা।

এ বিষয়ে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পাঁচ-ছয়টি জেলায় বন্যার পানি নামতে কিছুটা দেরি হতে পারে। সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ থেকে বন্যার পানি নামতে মাসের বাকি সময়ের পুরোটা লেগে যেতে পারে। আজ রোববারের মধ্যে ঢাকার নিম্নাঞ্চল ডেমরায় বন্যার পানি চলে আসতে পারে।

>

বন্যার পানি ধীরে নামছে
উজান থেকে আরও পানি আসতে পারে
আজকের মধ্যে ডেমরায় পানি প্রবেশ করতে পারে

গত শুক্রবার সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বলছে, বন্যায় আক্রান্ত সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুরসহ কয়েকটি জেলায় খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। সংস্থাটির হিসাবে, এ পর্যন্ত ২১ জেলার ৪০ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৩টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ১ লাখ ৯ হাজার হেক্টর ফসলের জমি তলিয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্তমানে মাঠে আমন মৌসুমের বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন সবজি ও পাট রয়েছে। বন্যার কারণে পাটের খুব বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে বীজতলা ও সবজির ক্ষতি হতে পারে। বন্যার প্রভাবে বাজারে ইতিমধ্যে সবজির দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ-রসুনের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এসব পণ্য উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে বন্যা শুরু হওয়ায় সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।

দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি এবং সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং উজান থেকে অল্প সময়ে অনেক বেশি পানি চলে আসায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে এবার অনেক বেশি পানি এবং স্রোতও বেশি। ফলে অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে দিচ্ছে। তবে মাঠে এখন বড় ফসল নেই উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিটি জেলার উঁচু স্থানে আমনের চারা তৈরির জন্য বরাদ্দ পাঠিয়ে দিয়েছি। পানি নেমে গেলে কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে।’

জুলাইয়ের শুরু থেকে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিপাতের ফলে ইতিমধ্যে চীন, ভারত ও নেপালে বন্যা দেখা দিয়েছে। এই বন্যার পানি নেমে বঙ্গোপসাগরে পড়ার প্রধান পথ বাংলাদেশের নদীগুলো। মূলত ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও যমুনা দিয়ে এই পানি নেমে যায়। কিন্তু উজানের পানির বড় অংশ এখনো নামেনি।

এ বিষয়ে নদী বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ও যমুনার পানি এবার একটু দেরিতে নামবে বলে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পানি বৃদ্ধির ধরন ও উজানের বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, এই বন্যার পানি নামতে আগস্টের পুরো সময় লেগে যেতে পারে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে সুরক্ষিত এলাকাতেও পানি ঢুকে পড়েছে। এটা কেন হচ্ছে, সরকারকে তা দ্রুত খতিয়ে দেখতে হবে। অন্য জায়গায় যাতে এই পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।