ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্তকে হত্যার জন্য দুই ঘণ্টা সময় দেন 'বড় ভাই'

নিহত ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
নিহত ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাসকে হত্যার আগের রাতে এক আওয়ামী লীগ নেতার কার্যালয়ে বসে দেওয়া হয় নির্দেশনা। পরিকল্পনামতো কাজ শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয় দুই ঘণ্টা।

হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া মিজানুর রহমান নামের এক ছাত্রলীগের কর্মীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, হত্যার নির্দেশদাতা দিদারুল আলম (মাসুম)। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত তিনি।

১২ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সারোয়ার জাহানের আদালতে জবানবন্দি দেন মিজানুর রহমান। এর আগে তিন আসামি জবানবন্দি দিলেও এ খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে লালখান বাজারের এক ‘বড় ভাই’য়ের কথা বললেও তাঁর নাম বলেননি। ঘটনার ১ বছর ৯ মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো নির্দেশদাতা বড় ভাইয়ের নাম উঠে এল।

তবে গতকাল বিকেলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে দিদারুল আলম বলেন, এটা তাঁকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র।

২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর নগরের সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ ঘটনায় তাঁর বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় সাত-আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে আদালতের নির্দেশে গত ফেব্রুয়ারিতে মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পিবিআই সূত্র জানায়, সুদীপ্ত খুনের ঘটনায় ‘বড় ভাই’সহ ১৫-১৬ জনের নাম এসেছে। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করেন সুদীপ্ত। এ ঘটনার জেরে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার দেড় বছরের মাথায় সম্প্রতি একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। এতে খাইরুল নুর ইসলাম ওরফে খায়ের নামের এক আসামি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। পিবিআই মুঠোফোনটি উদ্ধার করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে।

ঘটনার পর ১৫ আসামি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে গেছেন ১২ জন। এখন কারাগারে আছেন আসামি মিজানুর রহমান, মো. রুবেল ওরফে টাংকির পাহাড়ের রুবেল ও মো. হানিফ ওরফে পিচ্চি হানিফ। এর মধ্যে মিজানুরকে ১১ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়।

যা আছে জবানবন্দিতে

আদালত সূত্র জানায়, পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে আসামি মিজানুর বলেন, সুদীপ্ত হত্যার আগের দিন (৫ অক্টোবর) রাতে নগরের লালখান বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলমের কার্যালয়ে আসামি আইনুল কাদের (নিপু), পিচ্চি হানিফ, ওয়াসিম উদ্দিন, মো. আরমানসহ ৮ থেকে ১০ জনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। দিদারুল তখন আইনুলকে নির্দেশনা দেন, ‘ঘটনাটা সকাল ছয় থেকে আটটার মধে৵ শেষ করবি। মোশরকে ভিডিও করে আনতে বলবি। আমি দেখব।’ লালখান বাজার মতিঝরনা এলাকায় একটি টংদোকানে বসে ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে চা খাচ্ছিলেন মিজানুর। ওই সময় আইনুল তাঁকে দিদারুলের কার্যালয়ে আসতে বলেন। সেখানে এসে এসব কথা শুনতে পান মিজানুর। আইনুল তাঁকে পরদিন নালাপাড়ায় (সুদীপ্তর বাড়ি) যাওয়ার জন্য বলেন।

জবানবন্দিতে মিজানুর বলেন, পরদিন ৬ অক্টোবর পরিকল্পনামতো নগরের লালখান বাজার থেকে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে করে নালাপাড়ায় সুদীপ্তের বাসার সামনে যান প্রায় ১৫ থেকে ১৬ জন। গলির মুখে তিনিসহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকেন। দুই থেকে তিন মিনিট পর হট্টগোলের শব্দ পান। আইনুল, খায়ের, ওয়াসিম, মোশর, পিচ্চি হানিফ, বাবু, বাপ্পী, নওশাদ দৌড়ে গলি থেকে বের হয়ে আসেন। তাঁদের হাতে লোহার রড ও পাইপ ছিল। আইনুল বলেছিলেন, ‘সবাই সিএনজিতে উঠে যা। এরপর সবাই লালখান বাজার এসে যে যাঁর মতো চলে যান। ঘটনার দিন দুপুরে টেলিভিশনে খবর দেখে জানতে পারেন সুদীপ্ত মারা গেছে।’

আদালতে মিজানুরের জবানবন্দির তথ্য উল্লেখ করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ হত্যা মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে।’

দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মামলাটির তদারককারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন গতকাল বিকেলে বলেন, ‘সময় হলে সব জানতে পারবেন।’

ছেলের খুনের নির্দেশদাতাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস। তাঁর মতে, ‘তা না হলে দল হারাবে কর্মীকে। খালি হবে মা-বাবার বুক।’

ফাঁসানোর অভিযোগ দিদারুলের

জিজ্ঞাসা করা হলে সুদীপ্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন দিদারুল আলম। গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানোর জন্য মিজানকে দিয়ে মিথ্যা বলানো হয়েছে। এ সবকিছু করেছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত (বেলাল)। কারণ, লালখান বাজার থেকে আমাকে উচ্ছেদ করে চাঁদাবাজি করাই তাঁর লক্ষ্য।’

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আবুল হাসনাত বলেন, ‘পুলিশ আসামি ধরেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। সেখানে কারও কিছু করার সুযোগ নেই।’