রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ

পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের মোট ক্রয় পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ। ক্রয় পরিকল্পনায় একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি সই এবং চুক্তি সমাপ্তির ক্ষেত্রে একাধিক তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ‘ধারণাগত’ উল্লেখ করে তা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে বলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

গত ১ এপ্রিল প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহর দেওয়া প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

 শুধু কেনাকাটা ত্রুটিপূর্ণ নয়, আইএমইডি সচিবের দেওয়া প্রতিবেদনে প্রকল্পের যে অংশ বাংলাদেশ সম্পন্ন করবে, তার কোনো পরিকল্পনাও নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের সব থেকে বড় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনে সময়মতো এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রকল্পের সময় বাড়লে সে ক্ষেত্রে ব্যয়ও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ভিভিইআর প্রযুক্তির ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সালে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণে রাশিয়ার সরকারি সংস্থা রাশিয়ান স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটম) সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টকে কেন্দ্র নির্মাণের ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। এ চুক্তির ওপর ভিত্তি করে গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। এ বাস্তবতায় ভারত এখন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা, লোকবল প্রশিক্ষণ, এমনকি কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। তবে ত্রিদেশীয় চুক্তির অংশ হিসেবে রূপপুর প্রকল্পের আবাসন প্রকল্পসহ কিছু অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করার কথা বাংলাদেশের।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইএমইডির সচিব নিজে সরেজমিনে গিয়ে রূপপুর প্রকল্পের কেনাকাটায় ত্রুটি ধরতে পেরেছেন। যখন বালিশ কিনতে এবং তা খাটে তুলতে নজিরবিহীন অর্থ ব্যয় করার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন আমরা বলেছিলাম, এটি হলো দুর্নীতির উপরিভাগ। রূপপুর প্রকল্পের গোটা ক্রয় প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ, এখন আইএমইডি সেই কথাই বলছে।’ তাঁর মতে, রূপপুর প্রকল্পের ক্রয়প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত, সরকারের উচিত তাদের সবাইকে কড়া জবাবদিহির আওতায় আনা। একই সঙ্গে দ্রুত স্বচ্ছ ক্রয়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব কেনাকাটা করা উচিত।

>

প্রকল্প পরিদর্শন শেষে আইএমইডি সচিবের প্রতিবেদন
সময়মতো নির্মাণকাজ শেষ হওয়া নিয়েও প্রশ্ন

 বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে। আইএমইডির প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চেয়ে ৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে প্রথমে কল এবং পরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদনটি তিনি দেখেননি। তবে রূপপুর ক্রয় পরিকল্পনায় ত্রুটি নেই, ত্রুটি থাকার সুযোগও নেই। তিনি মনে করেন, আইএমইডির সঙ্গে কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে এ রকম প্রতিবেদন দিয়ে থাকতে পারে।

প্রসঙ্গত, রূপপুর প্রকল্পে কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার অনিয়ম হয়েছে পদে পদে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাবনা ও রাজশাহীর পূর্ত বিভাগের ৩৪ জন প্রকৌশলী অস্বাভাবিক এ কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে এই অনিয়মের জন্য ৩৪ জন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়।

আইএমইডির প্রতিবেদন

আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছেন, রূপপুর প্রকল্পের মোট ক্রয় পরিকল্পনায় ত্রুটি রয়েছে। কেনাকাটায় একাধিক পদ্ধতি ও দরপত্র আহ্বানের মধ্যে এই ত্রুটি রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা একেক জায়গায় একেক রকম তথ্য রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ যেসব অবকাঠামো ও কেনাকাটা করবে, রাশিয়ার অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে তার সমন্বয় রেখে করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সমন্বিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা না থাকায় প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর অগ্রগতিও নিরূপণ করা যায়নি বলে প্রতিবেদন বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রকল্পটির নির্মাণ সময় ধরা হয়েছে ১১৪ মাস। সে অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তবে গত মার্চ পর্যন্ত ৩৩ মাসে ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে প্রকল্পের। প্রকল্প শেষ করতে ৮১ মাস বাকি। আর এ সময় ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পাদনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।