চার জেলায় 'ছেলেধরা' সন্দেহে ১৩ জনকে গণপিটুনি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও লালমনিরহাটে ছেলেধরা সন্দেহে ১৩ জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। গতকাল শনিবার ও আজ রোববার এই ঘটনাগুলো ঘটে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

নওগাঁ: জেলার মান্দা উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে আজ ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনির শিকার ছয় ব্যক্তি হলেন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, তসলিম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল মজিদ আকন্দ ও আনিছুর রহমান এবং সদর উপজেলার ফারতপুর গ্রামের রেজাউল করিম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৮টার দিকে এই ছয়জন উপজেলার বুড়িদহ গ্রামের রণজিৎ কুমার চৌধুরীর পুকুরে চুক্তিভিত্তিক মাছ ধরতে যান। পুকুরের মালিকের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ছিল যে তাঁরা শুধু ছোট মাছ ধরবেন। কিন্তু তাঁরা কয়েকটি বড় মাছও ধরে ফেলেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে পুকুরমালিকের কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুকুরের মালিক ও গ্রামের লোকজন ছয় জেলেকে মারধর করতে শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ‘ছেলেধরা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলে আরও লোকজন ছুটে গিয়ে প্রথমে সাদ্দাম হোসেন নামের এক জেলেকে আটক করেন। ‘ছেলেধরা’ পালিয়ে গেছে খবর রটে গেলে পাশের খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের লোকজন অন্য পাঁচজন জেলেকে আটক করে পিটুনি দেয়।

মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গ্রামবাসী ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তাঁরা এখন থানা হেফাজতে আছেন। ঘটনা তদন্তে তাঁদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এটা পুরোপুরি গুজব। এ ধরনের গুজবে কাউকে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজন গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন। শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড়, সদর উপজেলার কান্দিলা ও কালিহাতী উপজেলার সয়াপালিমা গ্রামে পৃথক এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, আজ সকালে সদর উপজেলার কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। তাঁর নাম আকাশ (৪২)। বাড়ি গাজীপুর। দুপুরের দিকে কালিহাতী উপজেলার সয়াপালিমা গ্রামে গণপিটুনির শিকার হন অজ্ঞাত এক যুবক। তাঁকে পুলিশ উদ্ধার করে কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। এ ছাড়া গতকাল রাত ১১টার দিকে শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড় এলাকা থেকে গণপিটুনির শিকার একজনকে পুলিশ উদ্ধার করে। টাঙ্গাইল সদর থানার পুলিশ (পরিদর্শক) মো. সালাউদ্দিন বলেন, কাউকে অপরাধী বলে সন্দেহ হলে পিটুনি না দিয়ে পুলিশে দেওয়ার জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে।

কুমিল্লা: ছেলেধরা সন্দেহে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার দুতিয়ার দিঘির পাড় এলাকায় এক নারীসহ তিনজনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। তাঁরা হলেন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের আবদুস সালাম (৭০), তাঁর স্ত্রী রত্না বেগম (৪০) ও একই গ্রামের রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৩০)। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত তিনজন ব্যক্তি বলেন, আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাম ও রত্না দম্পতি রিকশা নিয়ে আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলি ইউনিয়নের দুতিয়ার দিঘি এলাকায় যান। একটি বাড়ির সামনে গিয়ে স্কুলগামী এক শিশুকে কথা আছে বলে ডাক দেন। তখন আশপাশের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে চিত্কার করেন। এই সময়ে তাঁরা রিকশা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে জনতা তাঁদের ধরে পিটুনি দেন। পরে পুলিশে খবর দিয়ে তাদের সোপর্দ করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গতকাল কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার পেয়ারাপুর এলাকায় রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামের এক ভিক্ষুককে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দিয়ে তাঁর পা ভেঙে দেন এলাকাবাসী। তিনি বর্তমানে লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।

এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেধরা সন্দেহে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। কোথাও ভিন্ন কিছু চোখে পড়লে পুলিশকে জানান। গুজবে কান না দেবেন না।’

লালমনিরহাট: ছেলেধরা সন্দেহে গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে লালমনিরহাট শহরের খোঁচাবাড়ি মৌজার ডাইলপট্টি এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে (৪৫) আটক করে এলাকাবাসী পিটুনি দেয়। সংবাদ পেয়ে ওই নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে লালমনিরহাট সদর থানার এসআই জিল্লুর রহমান আহত হন। বর্তমানে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লালমনিরহাট সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এরশাদুল আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। লালমনিরহাটের এসপি এস এম রশিদুল হক বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নিলে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’