ত্রাণের জন্য অপেক্ষা প্রভাত, জয়নবদের

গাইবান্ধায় বেসরকারিভাবে কিছু জায়গায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সদর উপজেলার কালীর বাজার এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধায় বেসরকারিভাবে কিছু জায়গায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সদর উপজেলার কালীর বাজার এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

প্রভাত চন্দ্র বর্মণ শারীরিক-প্রতিবন্ধী। বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী গ্রামে। বাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ধান-চাল-ডালসহ শুকনো খাবার। প্রভাত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিদ্যালয়ে। ত্রাণের খোঁজে গতকাল সোমবার গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়কে ঘুরছিলেন তিনি।

সড়কে জটলা দেখে এসে প্রভাত বললেন, ‘হামার নামটাও ইলিপের (ত্রাণ) তালিকায় দ্যান বাহে, হামি কিচ্চু পাইনি।’

ত্রাণের জন্য এ অপেক্ষা শুধু প্রভাতের নয়। তাঁর মতো অনেকেই পথ চেয়ে বসে আছেন। তাঁদের অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এ চিত্র ফুলছড়ির দুটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের।

গাইবান্ধা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে উদাখালী গ্রাম। সদর থেকে গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়ক ধরে সেখানে যেতে দেখা যায়, ফুলছড়ির শান্তির মোড় পর্যন্ত গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ। সড়কের মাঝখানে অল্প ফাঁকা জায়গা। এর মধ্যে দিয়ে চলাচল।

হরিপুরের বাসিন্দা দিনেশ চন্দ্রও ওই সড়কে ঘুরছিলেন। খাবার না মেলায় সন্তানদের কাছে যেতে পারছিলেন না তিনি। বললেন, ‘সাতটা দিন ধরে পানিত ভাসিচ্চি। ঘরত এনা দানাপানি নাই। বিস্কুট, মুড়ি খায়্যা দিন যাচ্চে। বানের পানি খাচ্চি। ঘরত ধান ছিল, তা-ও বস্তার মধ্যে পচিচ্চে।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এরই মধ্যে ত্রাণ হিসেবে ১ হাজার ১০০ টন চাল দেওয়া হয়েছে। শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে ছয় হাজার প্যাকেট। প্রতিটি বানভাসি মানুষকেই ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। একেক পরিবারের অন্তত দুই কেজি করে চাল পাওয়ার কথা।

>

ফুলছড়ি উপজেলার বন্যাকবলিত দুটি ইউনিয়ন উদাখালী ও উড়িয়া
এখানকার অধিকাংশ মানুষ ত্রাণ পায়নি
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন

গতকাল ফুলছড়ির দুটি ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ বানভাসি চাল পায়নি। এ দুটি ইউনিয়ন হলে উদাখালী ও উড়িয়া।

উদাখালীর প্রতিটি গ্রাম এখনো পানিতে ভাসছে। বাড়িঘরের জানালা দিয়ে পানি ঢুকে দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। গত কয়েক দিনে পানি একটু কমেছে। এতে উদাখালী গ্রাম পর্যন্ত সড়ক কিছুটা ঠিক হয়েছে। তবে খোদ উপজেলা সদরে নৌকা ছাড়া উপায় নেই।

উপজেলা সদরের পাশেই কালিরবাজার এলাকায় বুড়াইল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এখানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে তিন শতাধিক মানুষ। এখানে দোতলার একটি কক্ষে ৯টি পরিবারের ৩৫ সদস্য একসঙ্গে রয়েছেন। তাঁদের একজন রওশন আরা।

রওশন আরা জানালেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। দক্ষিণ বুড়াইল গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেখানে এখনো বুকপানি। পানি কিছু কম হওয়ায় বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখেন, সব পচে গেছে। শুধু টিন আর বেড়া ভাসছে। সকাল থেকে তিনি না খেয়ে আছেন।

উত্তর বুড়াইল গ্রামের আরেক বিধবা সামিনা বেগম গবাদিপশুসহ একই কেন্দ্রের দোতলার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। এ বারান্দায় অন্তত ২০টি গরু রাখা। কক্ষগুলো মানুষে ভরপুর। বারান্দা গবাদিপশুর মলমূত্রে একাকার। পা ফেলায় উপায় নেই। এর মধ্যে শিশুরা হাঁটছিল। এখানকার এক কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন সকিনা খাতুন।

সকিনা বললেন, তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। এক সপ্তাহ আগে এ কেন্দ্রে আসেন তিনি। এ পর্যন্ত ত্রাণ পাননি।

উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে পূর্ব হালুয়া গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এখনো থইথই পানি। বাড়ির আঙিনায় কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, ত্রাণ সবার জন্য নয়। ত্রাণ আসে চেয়ারম্যানের খাওয়ার জন্য।

উদাখালী ইউনিয়নে প্রায় ৩২ হাজার বাসিন্দা। এখানকার ১৬টি গ্রামই প্লাবিত। এ পর্যন্ত এ ইউনিয়নে ১৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখানকার চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বললেন, মানুষজন বিচ্ছিন্নভাবে আছে বলে সবাইকে এখনো ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

উড়িয়া ইউনিয়নের কয়েক শ মানুষ যমুনার নদীর ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কোনোমতে পলিথিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে থাকছে। কেউবা পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে। এ বাঁধের কাছে নৌকা গেলে বানভাসিরা স্রোতের বেগে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে একজন জয়নব বেগম।

জয়নব জানান, তিনি বিধবা। বাড়ি রতনপুরে। আট দিন ধরে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ খবর নেননি। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, সরকার খাবার দিয়েছে। কিন্তু আমাদের তা দেওয়া হয়নি।’ একই গ্রামের রুবি বেগমও বিধবা। তিনিও এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভোটের সময় সবাই কদর করে। অভাবের সময় কেউ নেই।’

ওই গ্রামের রুহুল আমীনের স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, তাঁদের শুকনো খাবার শেষ। কেউ সাহায্য করছেন না। ত্রাণ নেওয়ার জন্য বোধ হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। এখানকার জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ দেবেন না। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান সরকারের মুঠোফোনে কল করা হলে একজন ধরে বলেন, চেয়ারম্যান অসুস্থ। কথা বলতে পারবেন না।