আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না

>

চারদিকে নির্মমতার নানা ঘটনা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে হবে রাষ্ট্রকে। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণপিটুনিতে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট তিন নাগরিক।

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান


মানবিক মূল্যবোধের বড় ক্ষয় হয়েছে
আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক

আমরা যে নিজেদের নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালি বলে অভিহিত করে আসছি, তার যাথার্থ্য সম্পর্কে এখন সত্যি সত্যিই প্রশ্ন জেগেছে। মানুষের মধ্যে যে নির্মমতার পরিচয় আমরা প্রতিদিন পাচ্ছি, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। ধর্ষণ–অপহরণ তো আছেই, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকে সবাই মিলে মেরে ফেলার ঘটনা দেশের নানা স্থানেই দেখা যাচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই নিহত ব্যক্তি যে নির্দোষ, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তা ছাড়া ব্যক্তিটা দোষী হলেও নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার যে মানসিকতা, সেটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের একেবারেই বিরোধী। আমরা একই সঙ্গে অভিযোক্তা ও বিচারক হতে পারি না, সেই সঙ্গে আবার দণ্ড বাস্তবায়নের ভারও নিতে পারি না।

আসলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের বড় রকম ক্ষয় হয়েছে। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হয়ে যাচ্ছে, সামান্য টাকা বা জিনিসের কারণে একজন আরেকজনকে হত্যা করছে, গুজব ছড়িয়ে মানুষ মারা হচ্ছে। একটা আওয়াজ তুললেই চারপাশের লোক এসে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে। কোনো সভ্য সমাজে এমন হতে পারে না। আমরা মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে কোথাও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা নেই ও তার পরিবেশ নেই। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় কত ভালো করছে, বাবা–মায়ের এবং শিক্ষকের সেটাই বিচার্য। সন্তানের মধ্যে মানবিক গুণের বিকাশ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা একেবারেই উদাসীন। কর্মক্ষেত্রে আত্মিক সহমর্মিতা গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা নেই, নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যাপৃত। এই রকম সামাজিক অবস্থায় মূল্যবোধের অবক্ষয় অনিবার্য।

আমাদের চেষ্টা করতে হবে গোড়া থেকেই। মানবিক মূল্যবোধ যাতে গড়ে ওঠে এবং বজায় থাকে, সে বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। সংসারে, সমাজে বিরোধ তো থাকবেই। কিন্তু তার শান্তিপূর্ণ সমাধানই যেন লক্ষ্য হয়, তা–ও নিশ্চিত হতে হবে। গুজবে কান দেওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, দেশে প্রশাসন আছে, আইনি ব্যবস্থা আছে, সেসবের প্রতি আস্থা না থাকলে সামাজিক সংগঠনটাই বিনষ্ট হয়ে যায়। আমরা সেই বিনষ্টির পথ থেকে যেন নিজেদের ফিরিয়ে আনি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আগে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ

প্রথম কথা হলো, বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ ও ক্রোধ জমছে। কিন্তু মানুষ তা প্রকাশের কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় তারা আক্রমণ করার মতো কাউকে সামনে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু মানুষকে যেভাবে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসছে না।

সাধারণভাবে মনে হচ্ছে, মানুষের মনে গভীর আস্থাহীনতা কাজ করছে। মানুষ মনে করছে, দোষী কোনো ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আদালতে গেলে ন্যায়বিচার হবে না। একদিকে ক্রোধ, অন্যদিকে আস্থাহীনতা—এ জন্যই মানুষ বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এটি মোটেই কাম্য নয়।

মানুষ আবার অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য খবরও পাচ্ছে না। ফলে গুজবের পেছনে ছুটছে। এমন পরিস্থিতিতে সবার আগে প্রয়োজন মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। সে জন্য অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে পুলিশের হাতে অপরাধীকে সোপর্দ করা হলে এবং আদালতে গেলে তার যথার্থ বিচার হবে।

মানুষের মধ্যে এখন সামাজিক যোগাযোগও খুব কমে গেছে। সামাজিক সম্পর্কটা কাজ করছে না। মানুষ কোণঠাসা অবস্থায় বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করছে। আগে নাটক হতো, গান হতো, মানুষ পাঠাগারে যেত। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতো। এর মাধ্যমে সমাজে সবার মধ্যে মেলামেশার একটা পরিবেশ গড়ে উঠত। সেসব এখন আগের মতো নেই।

 সামাজিক এই ক্ষয় দূর করতে হলে মেলামেশার সুযোগ অবারিত করতে হবে। মেলামেশার পরিসর বাড়াতে হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন উজ্জীবিত করতে হবে।

সবার প্রতি আমার আবেদন হলো, আমাদের সহনশীল হতে হবে। মননশীলতা ধরে রাখতে হবে। মননশীলতা চলে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। এ জন্য মননশীলতার চর্চা সবচেয়ে বেশি দরকার। আর এই চর্চাও সামাজিকভাবেই করতে হবে।

রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী

সমাজে অস্থিরতা থাকলে এমন ঘটনা বাড়ে
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

প্রথমত গণপিটুনির মতো নিষ্ঠুর ঘটনা শুধু অনভিপ্রেতই নয়, কোনো সভ্য সমাজেই তা কাম্য হতে পারে না। আইনের শাসন ঠিকমতো না থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে থাকে। পত্রিকাতেই এসেছে, আট বছর আগে (২০১১ সালে) ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল; কিন্তু ঘটনার আট বছর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এই মামলা বিচারকাজ শেষ হয়নি।

যখন বিভিন্ন কারণে মানুষের মনে আস্থা কমে যায় এবং সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে, তখনই মানুষ এমন পথ বেঁচে নেয়। অনেকে হুজুগে মেতেও গণপিটুনির মতো নিষ্ঠুর ঘটনায় অংশ নিচ্ছে। এসবের পেছনের বড় কারণ মনে হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বিচারকাজ দ্রুত শেষ করতে অনেক সময় আদালতও নিরুপায় থাকে। কারণ, এমনভাবে মামলার অভিযোগ সাজানো হয়, ফলে দীর্ঘসূত্রতা হয় এবং অনেক সময় ন্যায়বিচারও নিশ্চিত হয় না। এ জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের পার পেতেই হবে। এই জায়গায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

আর যেকোনো অপরাধ বেশি হতে থাকলে সামাজিক সচেতনতার কথা বলা হয়। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু রাষ্ট্রেরও তো দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্র যদি ঠিকমতো দায়িত্ব নেয়, তাহলে কিন্তু অপরাধের লাগাম টানা সম্ভব। যেমন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা কিন্তু এখন কমে গেছে।

আমরা গর্ব করে বলে থাকি, লেখাপড়ায় অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধের যেন একটা ছেদ পড়েছে। মনে হচ্ছে, এখন পড়াশোনাটা হয়ে গেছে সনদনির্ভর। মূল্যবোধের শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এখন তো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করেও অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। সেই সুযোগটাও নিতে হবে। যেকোনো অপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়। মানুষের মধ্যে একটা বার্তা দিতে হবে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। সর্বোপরি আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।