মা না এলে ভাত খাবে না ছোট্ট তাসমিন

তাসমিন
তাসমিন

টানা তিন দিন মায়ের দেখা পায় না তাসমিন। প্রথম দিকে মগ্ন ছিল পুতুলখেলায়, এখন তার মাকে চাই। মাকে ছাড়া সে খাবে না। বারবার বলছে, ‘মা কখন আসবে? মা কেন আসছে না? মা না এলে আমি ভাত খাব না।’

কাল সোমবার সারা দিন মায়ের অপেক্ষায় থেকে চার বছরের তাসমিন মাঝেমধ্যেই ভেঙে পড়ছিল কান্নায়। তার বড় ভাই ১১ বছরের তাহসিন আল মাহিন অন্তত বুঝতে পারে, তাদের মা আর কোনো দিন ফিরবেন না। তবে বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার অবস্থা তার নেই। শোকে-দুঃখে সে নির্বাক। একই অবস্থা তাদের আত্মীয়দেরও।

উন্মত্ত মানুষের বর্বরতায় আকস্মিক মা-হারা ছেলেমেয়ে দুটিকে কী বলে প্রবোধ দেবেন, তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। ছেলেধরা সন্দেহে তাদের মা তাসলিমা বেগমকে (৪০) গত শনিবার ঢাকার উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।

রোববার লক্ষ্মীপুরের রায়পুরার সোনাপুর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাসলিমাকে দাফন করা হয়েছে। তাসমিন ও তাহসিন এখন সেখানেই নানির বাড়িতে আছে।

স্কুলে থমথমে পরিবেশ
গতকাল সোমবার সরেজমিনে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল স্কুলের সামনে পুলিশি পাহারা। অন্যান্য দিনের মতোই সকাল আটটায় অ্যাসেম্বলি শেষে বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় চলছিল প্রথম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস। তবে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। অন্যান্য ক্লাসেও একই অবস্থা। পুরো স্কুলে একধরনের অস্বস্তিকর নীরব থমথমে পরিবেশ। শিক্ষকদের মধ্যেও ঘুরেফিরে আসছে শনিবারের সেই গণপিটুনির প্রসঙ্গ। স্কুলের ফটকের সামনে বরাবর কিছুসংখ্যক অভিভাবক অবস্থান করেন। ওই ঘটনার পর থেকে গত দুদিন ফটকের সামনেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষকেরা বলেছেন, গণপিটুনিতে নিরীহ ওই নারীকে হত্যার ঘটনা স্কুলের পরিবেশটাই বদলে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো একটি জায়গায় গুজবের কারণে মানুষ হত্যার ঘটনা তাঁরাও মেনে নিতে পারছেন না। আতঙ্কে স্কুলে আসছেন না অনেক শিক্ষার্থী। যারা ক্লাসে আসছে, তাদের মধ্যেও একধরনের ভয় কাজ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষিকা বলছিলেন, সব শ্রেণি মিলিয়ে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত শ। তাদের হইহুল্লোড়ে সারা দিন পরিবেশ মুখর থাকে। অথচ এখন সবাই চুপচাপ। কোনো কোনো ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা অর্ধেকের কম।

>

ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়
মায়ের শোকে ১১ বছরের ছেলের মুখে কথা নেই
৪ বছরের মেয়ের প্রশ্ন, মা কেন আসছে না?

গত শনিবার সকালে মেয়ের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে বাড্ডা উত্তর-পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান তাসলিমা বেগম। বছরের মাঝামাঝিতে ভর্তির তথ্য নিতে যাওয়ায় স্কুলের গেটে থাকা কয়েকজন অভিভাবক সন্দেহবশত তাঁকে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নিয়ে যান। এর মধ্যেই ছেলেধরা আটকের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অতিদ্রুত কয়েক শ উন্মত্ত মানুষ স্কুলের গেট ভেঙে ভেতরে আসেন। তাঁরা প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে দেয়ালে তাসলিমার মাথা ঠুকতে থাকেন। একপর্যায়ে লাথি-ঘুষি দিতে দিতে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে বেধড়ক লাঠিপেটা করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। নিহত তাসলিমার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের সোনাপুর গ্রামে। ঢাকার মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। দুই বছর আগে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনি ১১ বছরের ছেলে ও ৪ বছরের এক মেয়ের মা।

৩ জন রিমান্ডে, ১ জন কারাগারে
এদিকে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগমকে হত্যার ঘটনায় রোববার রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করে বাড্ডা থানা-পুলিশ। তাঁরা হলেন মো. শাহীন (৩১), বাচ্চু মিয়া (২৮), শহিদুল ইসলাম (২১) ও জাফর হোসেন (১৮)। জাফর খিলগাঁওয়ের একটি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, অন্যরা উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের দোকানি ও কারখানার কর্মচারী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানান বাড্ডা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক। তিনি জানান, বিভিন্নজনের মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দেখে তাঁদের শনাক্ত করা হয়।

সোমবার সকালে গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। জাফর হোসেন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ছেলেধরার কথা শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাসলিমাকে লাথি মেরেছেন এবং লাঠি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেছেন। শুনানি শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ অন্য তিনজনের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

যেভাবে গণপিটুনিতে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা
গ্রেপ্তারকৃত চারজনের মধ্যে মো. শাহীনের বাড়ি বাড্ডার সাতারকুলে। বাচ্চু মিয়া, জাফর হোসেন ও শহিদুল ইসলাম থাকেন উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজার এলাকায়। স্কুলটিও এই কাঁচাবাজারের পাশেই। গতকাল জাফর ও বাচ্চুর পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। স্কুল ভবনের পেছনেই শ/ ৮১ নম্বর বাড়িতে থাকেন জাফর। খিলগাঁওয়ের একটি কলেজে প্রথম বর্ষে পড়েন। তাঁর দাদা রহিম পাটোয়ারী বলেন, ঘটনার দিন সকালে জাফরের এক ফুফাতো ভাই খবর দেয়, স্কুলে ছেলেধরা আটক হয়েছেন। এই খবর শুনে সে ঘুম থেকে উঠেই ঘটনাস্থলে যায়।

জাফরের বাসার বিপরীতেই হাকিম মুন্সি রাইস মিলের কর্মচারী বাচ্চু মিয়া। জজ মিয়া নামের বাচ্চুর এক সহকর্মী বলেন, গত ঈদের পর থেকে দোকানে কাজ শুরু করেন বাচ্চু। স্কুলে ছেলেধরা আটক করা হয়েছে এই খবর শুনে বাচ্চু প্রথমে ঘটনাস্থলে যাননি। কিন্তু যখন মহিলাকে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে নামিয়ে সবাই মারতে শুরু করেন, তখনই তিনি ঘটনাস্থলে যান। যাওয়ার সময় বলেন, ‘কোনো দিন ছেলেধরাকে দেখিনি। আজ দেখে আসি।’

জজ মিয়া বলেন, গণপিটুনির যে ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে লাল টি-শার্ট পরা একজনকে পেটাতে দেখা যায়। বাচ্চু মিয়াও সেদিন লাল টি-শার্ট পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তবে মিনিট পাঁচেক পরেই তিনি আবার ফিরে আসেন।

মানববন্ধন
গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় মানববন্ধন করেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাসলিমা এই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। সোমবার সকালে মহাখালীতে প্রতিষ্ঠানটির সামনের সড়কে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানান।

শোকের গ্রাম সোনাপুর
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর প্রতিনিধি জানান, সোনাপুর গ্রামে এখনো শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে।

নিহতের ভাগনে নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার বছর বয়সী তাসমিনকে কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। তার একই কথা, মা আসলে খাবে, মা কখন আসবে। আর তাহসিন মাকে দাফন করার পর থেকে চুপ করে আছে। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। বোঝাতে পারছি না মানুষ কেন মাঝে মাঝে এত নিষ্ঠুর হয়।’