রোহিঙ্গা শিবিরে পাহাড়ধস ঠেকাতে 'সেফ প্লাস' কর্মসূচি

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবির। পাহাড়ধস ঠেকাতে বাঁশের বেড়া দিয়ে স্তর তৈরি করে গাছপালা লাগানো হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবির। পাহাড়ধস ঠেকাতে বাঁশের বেড়া দিয়ে স্তর তৈরি করে গাছপালা লাগানো হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

বর্ষা নামলেই কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দেখা দেয় আতঙ্ক। কারণ অধিকাংশ রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়া ও ঢালুতে। টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ শুরু হলে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি রোহিঙ্গা বসতিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ধসের ঘটনায় বিলীন হয় ঘরবাড়ি। সম্প্রতি টানা ১৫ দিনের ভারী বর্ষণে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি হারিয়ে গৃহহীন হয়েছে অন্তত ছয় হাজার মানুষ। পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। এখন উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯৫৩ জন।

রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে পাহাড়ধস ঠেকাতে তিন বছর মেয়াদি ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে পাহাড়ধস ঠেকাতে বনায়নের পাশাপাশি বনাঞ্চল উজাড় ঠেকাতে তারা জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে রোহিঙ্গা পরিবারে সরবরাহ দিচ্ছে এলপিজি গ্যাস।

২২ জুলাই উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, জুমশিয়া ও বালুখালী শিবির ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের ঢালুতে লাগানো হচ্ছে নিম, সেগুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। বৃষ্টির পানিতে যেন পাহাড়ধস না হয়, তার জন্য পাহাড়ের ঢালুতে বাঁশের বেড়া দিয়ে মাটি আটকিয়ে সৃজিত হচ্ছে সবুজ ঘাস ও গাছপালা।

মধুরছড়ার উঁচু পাহাড়ের খাদে ঝুপড়িতে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসতি করছেন রোহিঙ্গা রহিম উল্লাহ। তাঁর ঘরের চারপাশে লাগানো হয়েছে ১০-১২টি নিম ও সেগুনগাছ। গাছগুলোর উচ্চতা পাঁচ থেকে আট ফুট। আশপাশের পাহাড়েও অসংখ্য গাছপালা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

রহিম উল্লাহ (৫৫) বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাসে এই শিবির এলাকা এসে তিনি বড় বড় গাছপালায় ভরপুর বনাঞ্চল দেখতে পান। রোহিঙ্গারাই গাছপালা উজাড় এবং পাহাড় কেটে মাথাগোজার ঠাঁই করে নিয়েছিল। এখন কয়েক হাজার একরের বিশাল ক্যাম্প এলাকার কোথাও গাছপালা নেই। প্রচণ্ড গরমে যেমন ত্রাহি অবস্থা, তেমনি ভারী বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে।

কুতুপালং ও বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা আজমত উল্লাহ ও সলিম উল্লাহ বললেন, ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তাঁরা বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জ্বালানির চাহিদা পূরণ করেছিলেন। এখন কাঠের বিকল্প হিসেবে তাঁরা ইঞ্জিল চুলা (এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার) ব্যবহার করছেন। জাতিসংঘ বিনা মূল্যে তাঁদের এলপিজি দিচ্ছে।

আইওএমের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফের ৮ হাজার একর বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে গাছবিহীন ক্যাম্প এলাকায় ভয়াবহ নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা আছে। ২০১৮ সালে লাকড়ির চাহিদা কমিয়ে আনতে ক্যাম্পে ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি গ্রহণ করে বনায়নের পাশাপাশি শরণার্থী ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে গ্যাসের চুলা, এলপিজি গ্যাসের পাশাপাশি গ্যাস পুনরায় রিফিল করার সুবিধাও দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার পরিবারকে এলপিজি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

সেফ প্লাসের আইওএম ইউনিটের প্রধান প্যাট্রিক কেরিগনন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই কর্মসূচিটি খুবই সফল। কিন্তু তিন-বছর মেয়াদি এই কর্মপরিকল্পনার জন্য ৩০ শতাংশেরও কম অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে।

ডব্লিউএফপির কর্মকর্তা রাজিব মাহমুদ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল তৈরির জন্য বনাঞ্চলের দিকে হাত বাড়াতে হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের জন্য দৈনিক ১০ হাজার টন জ্বালানি কাঠের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে ৮ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। এখন ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে ‘সেইফ প্লাস’ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ডব্লিউএফপির তথ্য মতে, উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রায় ৬০ লাখ চারাগাছ রোপণের কর্মসূচি চলছে। ইতিমধ্যে তিন লাখ চারা রোপণ হয়েছে। তিন বছরে লাগানো হবে প্রায় ৬০ লাখ চারা। চারা উৎপাদনের জন্য উখিয়া ও টেকনাফে ৫০টির বেশি নার্সারি সৃজন করা হয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জ্বালানি কাঠের জন্য বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। রোহিঙ্গারা জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে বিনা মূল্যে এলপিজি গ্যাস পাচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষায় পাহাড়ধস ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ের ঢালুতে ঘাস সৃজনের পাশাপাশি ব্যাপক বনায়ন হচ্ছে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি কমে আসছে।