লোকদেখানো মশকনিধন

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাণহানির সংখ্যাও উদ্বেগজনক। মশার কামড় থেকে বাঁচতে বাসাবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতালেও মশারির ব্যবহার হচ্ছে। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।  ছবি: সাজিদ হোসেন
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাণহানির সংখ্যাও উদ্বেগজনক। মশার কামড় থেকে বাঁচতে বাসাবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতালেও মশারির ব্যবহার হচ্ছে। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সাজিদ হোসেন

এ বছর ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের আগে যে ঢিমেতালে মশকনিধন কার্যক্রম চলছিল, এখনো তা-ই চলছে। কোনো এলাকায় সপ্তাহে দুই দিন, কোনো এলাকায় ওষুধ দেওয়া হয় এক দিন। সকালে মশা মারার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না বললেই চলে। আর বিকেলে ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এভাবেই চলছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম।

মশকনিধন কার্যক্রম দেখতে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর চারজন প্রতিবেদক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭টি ওয়ার্ড ঘোরেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর, মশকনিধনকর্মী, মশক কার্যক্রম তত্ত্বাবধানকারীরা বলেছেন, এখন যেভাবে ও যতটুকু মশা মারার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তা পর্যাপ্ত নয়। আর নগরবাসীর মতে, মশকনিধনের কার্যক্রম লোকদেখানো।

দুই সিটি করপোরেশনে মোট ওয়ার্ড ৯৩টি। এর বাইরে নতুন ওয়ার্ড রয়েছে ৩৬টি। সিটি করপোরেশনে মশার লার্ভা মারার তরল ওষুধ লার্ভিসাইড ছিটানোর সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। আর পূর্ণবয়স্ক মশার ওষুধ এডাল্টিসাইড ছিটানোর সময় সূর্যাস্তের ১ ঘণ্টা আগে থেকে সূর্যাস্তের ১ ঘণ্টা পর পর্যন্ত।

ডিএনসিসির রামপুরার পশ্চিম উলন এলাকার একটি সদ্যনির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিচতলায় দুপুরে মশার কয়েল জ্বালিয়ে বসে ছিলেন মো. জুবায়ের। তিনি বলেন, কয়েল জ্বালানো ছাড়া কাজই করা যায় না। মো. জুবায়েরসহ উলন রোডের থাই প্লাস্টিক গলির পাঁচজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকার মূল সড়কে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্রের শব্দ শুনলেও গলির ভেতরে ওষুধ দেয়নি সিটি করপোরেশন।

ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট, পূর্ব মেরুল, উত্তর বাড্ডা, দক্ষিণ বাড্ডা, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুরার পশ্চিম উলন, পূর্ব উলন, ওয়াপদা রোড, ওমর আলী লেন, মহানগর আবাসিক এলাকা, ঝিলকানন, পূর্ব রামপুরা এবং ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হাজীপাড়া, নবীনবাগ, সিপাহীবাগ, মৌলভীর টেক এলাকা ঘুরে অন্তত ২০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই জানান, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁরা নিজেদের এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি।

মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের বাসিন্দা সাব্বির হাসান বলেন, ‘প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের কথা শুনছি। কিন্তু সে তুলনায় সিটি করপোরেশনের কোনো তৎপরতাই দেখি না। অথচ টিভিতে দুই মেয়র নানা কথা বলছেন। মাঝেমধ্যে বিকেলে বা সন্ধ্যায় মশার ওষুধ দেওয়ার মেশিনের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয় না।’

মশা নিয়ে আতঙ্কে দক্ষিণের বাসিন্দারা
লালবাগের ললিত মোহন দাস লেনের ১০ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতে থাকেন ডিএসসিসির ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির। দুপুরে বাড়ির মূল ফটকে বসে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষী শমশের আলী। তাঁর মতে, এলাকায় প্রচুর মশা। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কর্মযজ্ঞও ব্যাপক। প্রতিদিন সকাল-বিকেল নিয়ম করে এলাকায় ছিটানো হয় মশার ওষুধ।

>

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২টি ওয়ার্ড পরিদর্শন
পরিদর্শনে দেখা গেছে মশকনিধন কার্যক্রমের নানা ফাঁকফোকর
মশা মরছে না জেনেও সেই ওষুধ ব্যবহার করেছে সিটি করপোরেশন

কিন্তু কাউন্সিলরের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি দূরে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে একেবারে উল্টো তথ্য পাওয়া গেল। সেখানকার লোকজন বলছেন, চার-পাঁচ দিন পরপর বিকেলে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। সকালে তাঁরা কখনো ওষুধ ছিটাতে দেখেননি। একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে ডিএসসিসির ২২ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত ১০টি এলাকা ঘুরে।

এই দুই ওয়ার্ডে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন আনোয়ারুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর দুই ওয়ার্ডের প্রতিটিকে চারটি করে অংশে ভাগ করা হয়েছে। দুই ওয়ার্ডে ৬ জন করে মোট ১২ জন কর্মী নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। তাঁর দাবি, একবার ওষুধ ছিটালে তার কার্যকারিতা দু-তিন দিন থাকে। তাঁর ওয়ার্ডের প্রতিটি অংশে তিন দিন অন্তর অন্তর ওষুধ ছিটানো হয়।

আনোয়ারুল হকের দাবি, গত সোমবার টালি অফিস রোড ও মনেশ্বর রোডে ওষুধ ছিটানো হয়েছে। কিন্তু গতকাল ওই দুই এলাকার অন্তত ২০ জন বাসিন্দা জানিয়েছেন, চার-পাঁচ দিন আগে তাঁরা বিকেলের দিকে ওষুধ দিতে দেখেছেন। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কাজে হতাশা ও মশা নিয়ে নিজেদের আতঙ্কের কথাও তাঁরা জানান।

তবে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরিফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরীর মশকনিধনে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। ইতিমধ্যে ক্রাশ প্রোগ্রাম করেছি। এখন বাসাবাড়িতে এডিস মশার প্রজনন ধ্বংসে অভিযান চলছে। এ ছাড়া নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাড়া-মহল্লায় মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এডিশ মশা বাসাবাড়ির ভেতর বদ্ধ পানিতে জন্মায়। তাই বাসার ভেতর গিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে নাগরিকদেরই সচেতন হতে হবে।

সকালে ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না
মশকনিধনকর্মীদের বিরুদ্ধে সকালে লার্ভিসাইড ওষুধ না ছিটানোর অভিযোগই বেশি। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় ডিএনসিসির ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নানের কথায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকালে লার্ভিসাইড ছিটানোর জন্য বের হলেও অনেক কর্মী তা ছিটান না। কোথাও বসে থেকে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে দেন। প্রতিদিন সব কর্মীকে দেখভাল করাও সম্ভব হয় না।

ডিএসসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের টালি অফিস রোডে কথা হয় আবুল মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক দিন পরপর বিকেলে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু সকালে তিনি কখনো ওষুধ দিতে দেখেননি। সন্ধ্যা হলেই কয়েল জ্বালিয়ে বসে থাকতে হয়। ডেঙ্গু আতঙ্কে দিন কাটে তাঁদের।

বিকেলের ওষুধ শেষ হয় ১৫-২০ মিনিটে
সিটি করপোরেশনের একজন মশকনিধনকর্মী ফগার মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫ লিটার করে এডাল্টিসাইড ওষুধ দেন। এই ওষুধ মূলত কেরোসিনের সঙ্গে মিশানো হয়। একটি ফগার মেশিন চালু করা হলে ৫ লিটার ওষুধ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। একজন মশকনিধনকর্মীর জন্য নির্ধারিত এলাকা এই সময়ে হেঁটে শেষ করা সম্ভব হয় না। ফলে সপ্তাহের এক দিন বা দুই দিন সব এলাকাতেই যে ওষুধ দেওয়া হয়, তাও নিশ্চিত না।

ডিএনসিসির একজন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খোলা জায়গায় হেঁটে ফগার মেশিনে ওষুধ দিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। এটা অনেকটা লোকদেখানো। বদ্ধ জায়গায় বা ঘরের ভেতরে এই এডাল্টিসাইডের ধোঁয়া দেওয়া গেলে উড়ন্ত মশা মারা যেত। কিন্তু বাড়িঘরের ভেতরে সেভাবে ফগার দেওয়া যায় না।

এক এলাকায় সপ্তাহে এক দিন
ডিএনসিসি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, মশকনিধনকর্মীর নামের পাশে সপ্তাহের কোন দিন কোন এলাকায় ওষুধ ছিটাবেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে।

কর্মপরিকল্পনা ঘেঁটে দেখা যায়, সপ্তাহে এক দিন মশার ওষুধ দেওয়া হয় এমন এলাকাও আছে।

ডিএনসিসির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে মশকনিধনকর্মী আছেন ১৪ জন। তাঁরা সপ্তাহে এক দিন এক এলাকায় যাওয়ার সুযোগ পান। যেমন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের টানপাড়া জামতলা রোডে শুধু শনিবার ওষুধ ছিটানো হয়। এরপরের ৭ দিনে সেখানে মশার ওষুধ ছিটানোর কোনো কার্যক্রম থাকে না।

১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মশকনিধন কার্যক্রমের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহে দুই দিন করে ওষুধ দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের এলাকা এত বিস্তৃত যে তাতে সপ্তাহে দুই দিন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই একটি এলাকায় সপ্তাহে এক দিনই ওষুধ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

এলাকাভেদে সিটি করপোরেশনের মশকনিধনকর্মী বণ্টনেও রয়েছে পার্থক্য। শহরের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির একেকটি ওয়ার্ডে মশকনিধনকর্মী আছেন ১৩ থেকে ১৪ জন। আবার রামপুরা, মিরপুর, লালবাগ এলাকার ওয়ার্ডগুলোতে মশকনিধনকর্মী আছেন ৫ থেকে ৭ জন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৩-এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফাহমিদা মনির বলেন, তাঁর অঞ্চলে ১২টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একেকটি ওয়ার্ডে ছয়জন করে মশকনিধনকর্মী রয়েছেন। তাঁরা গড়ে চার দিন পরপর একেক এলাকায় মশার ওষুধ ছিটান। এই নিয়মেই ডিএসসিসির মশকনিধন কার্যক্রম চলছে। তবে এর মধ্যে মশা জন্মালে তার প্রতিকার কী হবে, তিনি তা বলতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা গত বছর মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা দেখেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারতে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তা অকার্যকর। তাতে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা মরে না। তখন ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আবার গবেষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। তারাও দেখতে পায়, ওষুধে মশা মরছে না। সব জেনেও সেই ওষুধ ব্যবহার করেছে সিটি করপোরেশন।

কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তা দিয়ে কোনোমতে ধোঁয়া দিয়ে গেলে মশা মরবে না। বাড়িঘরের ভেতরে এডাল্টিসাইডের ধোঁয়া পৌঁছাতে হবে। আর লার্ভা মরছে না বলেই মশা হচ্ছে। তার মানে লার্ভিসাইড ঠিকমতো ছিটানো হচ্ছে না।

[প্রতিবেদন করেছেন সামছুর রহমান, নাসরিন আকতার, সাদ্দাম হোসাইন, মুসা আহমেদ]