প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে পড়ছে কাচ

ভেঙে পড়ছে আজিমপুর কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর হিসেবে লাগানো কাচ। সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
ভেঙে পড়ছে আজিমপুর কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর হিসেবে লাগানো কাচ। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য স্বচ্ছ কাচ দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর তৈরি করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। অর্ধশত কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই সীমানাপ্রাচীর হিসেবে লাগানো কাচ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দুর্ঘটনার। এতে স্থানীয় ও পথচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

 নগর বিশেষজ্ঞরা কবরস্থানে এভাবে কাচের প্রাচীর তৈরির বিষয়টিকে বলেছেন ‘অন্যায্য অতিরিক্ত খরচ’। এই উদ্যোগ পরিবেশবান্ধবও নয়। তাঁদের মতে, ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি প্রকাশের জন্য আমাদের দেশে বিভিন্নজন কাচের সীমানা তৈরি করেন। কবরস্থানের মতো গণপরিসরে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।

কবরস্থানে কাচের প্রাচীর লাগানো সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মতামত অনেক রকম থাকতেই পারে। সেখানে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। এসব স্থাপনা নির্মাণের আগে নকশার কমপিটিশন হয়। স্থানীয়দের মতামত নেওয়া হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষ করেই আমরা চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ডিএসসিসি সূত্র বলছে, সংস্থাটির বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্পের অংশ হিসেবে আজিমপুর কবরস্থানের উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। এতে কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর, ছাদসহ হাঁটাপথ, পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন ও বৈদ্যুতিক ঘড়ি স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কাজে এই প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা। খোকন ট্রেডিং এজেন্সি ও আমান ট্রেডার্স যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু হয়েছে, শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় নতুন করে আরও ৯ মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন কাজ শেষ করার কথা ২০২০ সালের এপ্রিলে। সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের খরচও বাড়বে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে সীমানাপ্রাচীর হিসেবে স্বচ্ছ কাচ লাগানো হয়েছে। তবে নিয়মিত পরিচর্যা না করায় কাচের ফলকে ধুলো–ময়লার পুরু আস্তর জমে অস্বচ্ছ ও নোংরা হয়ে গেছে। তিনটি কাচের ফলকে ফাটল ধরেছে। যেকোনো সময় এগুলো ভেঙে পড়তে পারে। স্থানীয়রা বলছেন, মাস ছয়েক আগে কাচ লাগানো হয়েছে। এর কয়েক দিন পরই এগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। কাচ ভেঙে কয়েকজন পথচারী ও ভিক্ষুক আহতও হয়েছেন।

দেখা গেছে, ফাটল ধরা ওই  কাচ ঘেঁষেই পথচারীরা চলাচল করছেন। ভিক্ষুকেরাও তার আশপাশে বসে আছেন।

দেখা গেছে, আজিমপুর কবরস্থানের ভেতরে হাঁটাপথ নির্মাণ ও পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার কাজ করছেন শ্রমিকেরা। কবরস্থানের ভেতরেই কয়েকজন নির্মাণশ্রমিককে মাদক সেবন করতে দেখা গেছে।   

 স্থানীয় আরেফিন হোসেনের অভিযোগ, ইতিমধ্যে কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর হিসেবে যে কাচ লাগানো হয়েছে, তা টেকসই হয়নি। কবরস্থানের পাশেই মসজিদের বারান্দায় যেসব কাচ লাগানো হয়েছে, সেগুলোও ভেঙে পড়ছে।

এভাবে কাচের সীমানাপ্রাচীরের বিপক্ষেই মত দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, কাচের দেয়াল তৈরি পরিবেশবান্ধব নয়, এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার উষ্ণতা বেড়ে যায়। তা ছাড়া, এ ধরনের দেয়াল স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয়ও বেশি। তাই কাচের দেয়াল না দিয়ে ছোট ছোট খুঁটি দিয়ে দেয়াল বানানো উত্তম। এতে বাইরে থেকে ভেতরের দৃশ্যও যেমন দেখা যাবে, তেমনি এটি পরিবেশবান্ধব হবে।

এই প্রকল্পের পরিচালক ডিএসসিসির অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংস্থাটির অঞ্চল-৩ (আজিমপুর)–এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে অঞ্চল-৩–এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে আনা নরমাল টেম্পার গ্লাস দিয়ে সীমানাপ্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। কবরস্থান সংস্কারকাজে আনা পাথর আনলোডিং করতে গিয়ে কয়েকটি কাচ ভেঙে গেছে। তা সংস্কার করা হয়েছে। যেগুলো ভাঙার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেগুলোও সংস্কার করা হবে।

কবরস্থানের সীমানা কাচ দিয়ে ঘেরাকে ‘অন্যায্য অতিরিক্ত খরচ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ‘একটি বিপণিবিতানের সামনেও কাচের দেয়াল দিতে বহুবার চিন্তা করা হয়, কারণ এখানে বহু মানুষের সমাগম হবে। যেকোনো সময় এটি ভেঙে যেতে পারে, ভাঙচুরের শিকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কবরস্থানের মতো জায়গায় কাচের দেয়াল তৈরিতে আশ্চর্য হচ্ছি।’ তিনি বলেন, এ ধরনের কাচ অনেক দামি, তাই এটি একধরনের অপচয়। অনেকেই ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি প্রকাশের জন্য বাড়িতে কাচের দেয়াল দেন।