ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষক

বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া চর থেকে সহস্রাধিক গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ। গতকাল গাইবান্ধার কামারজানি ইউনিয়নের করাইবাড়ির চরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উঁচু স্থানে।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া চর থেকে সহস্রাধিক গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ। গতকাল গাইবান্ধার কামারজানি ইউনিয়নের করাইবাড়ির চরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উঁচু স্থানে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

গাইবান্ধা সদরের ফুলবান্দি বাজারের পাশে সড়কের ওপর বানের পানিতে ভেজা ধান শুকাচ্ছিলেন গোলেনুর বেগম (৫০)। বস্তায় থাকা অবস্থায় ভিজে গিয়েছিল ধানগুলো। তাই চারা গজিয়ে গেছে। পাশেই আধা পচা ভুট্টা শুকাতে দিয়েছেন মনোয়ারা বেগম। নাকে আসছে ধান ও ভুট্টার পচা গন্ধ।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে গোলেনুর বলেন, ‘এই ভিজে যাওয়া ধান-ভুট্টা শুকাচ্ছি; এগুলা খাইয়্যাই আমাগেরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবি। ধানের বীজতলাও ডুবি গ্যাচে। আবার ফসল কবি পাব ঠিক নেই।’

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের হিসাবে, উজানের ঢল আর বৃষ্টিতে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অন্তত ৪২৪টি গ্রাম পানির নিচে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ছয় লাখ মানুষ। ১৫ দিন ধরে ফসলি জমিতে পানি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এবারে বন্যার কারণে অন্তত ১৪ হাজার হেক্টর আবাদি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে রোপা-আউশ ধানের তিন হাজার, পাটের সাড়ে ছয় হাজার, সবজি পৌনে দুই হাজার ও পৌনে তিন হাজার হেক্টর আমনের বীজতলা ডুবেছে। এতে জেলার কৃষকদের অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে।

গাইবান্ধা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঘাঘট নদ। প্রায় সাত কিলোমিটার পূর্বে তিস্তা নদী। তিস্তার পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র। গাইবান্ধার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘাঘট কিংবা তিস্তার বাঁধ না ভাঙলে গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়িতে (বেশির ভাগ ইউনয়ন) বন্যা হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি, গত ১০০ বছরের গাইবান্ধায় এত বড় বন্যা হয়নি।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, নদী এলাকায় বন্যা হলে পানি দ্রুত নেমে যায়। কিন্তু গাইবান্ধায় আকস্মিকভাবে বাঁধ ভেঙে কৃষিনির্ভর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় পানি নামতে বা শুকাতে কয়েক মাস লাগবে। এই বন্যা কৃষিতে বড় রকমের সংকট সৃষ্টি করবে।

গতকাল ও গত সোমবার গাইবান্ধা সদর (একাংশ) ও ফুলছড়ি উপজেলার তিনটি (উদাখালী, উড়িয়া, কঞ্চিপাড়া) ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী গ্রামের হরিপুর, শান্তির মোড়, উপজেলা ভবন, উত্তর বুড়াইল, দক্ষিণ বুড়াইল এলাকায় থইথই পানি। কৃষিজমি, ঘরবাড়ি সব পানির নিচে। কারও বাড়িতে একবুক পানি। কারও আঙিনা দিয়ে এখনো স্রোত বইছে। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনেই হাঁটুপানি। কেতকিহাটের চারপাশের গ্রাম এখনো পানির মধ্যে। একই ইউনিয়নের বালাসীঘাট এলাকার বসতবাড়িগুলোতেও পানি। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সড়কের ওপর।

ফুলছড়ির উদাখালী ইউনিয়নের ইনছার আলী বলেন, হঠাৎ বন্যায় সব ভেসে গেছে। বন্যাটা এমন ছিল যে জীবন বাঁচানোটাই দায় হয়ে পড়েছিল। ধান-চাল সব ঘরের মধ্যে, ঘরে বুকসমান পানি। সব পচে শেষ। পানি পুরোপুরি নামতে কয়েক মাস লাগতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।

সদর উপজেলা থেকে কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। সদর থেকে ওই ইউনিয়নে যাওয়া পাকা সড়কে মানুষ অস্থায়ী স্থাপনা বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। শত শত গরু রাখা হয়েছে সড়কের ওপর। গতকাল কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের কাছে সড়কে ধান শুকাচ্ছিলেন খাদিজা খাতুন। তাঁর ধানগুলো প্রায় পচে গেছে। জানালেন, তাঁর বাড়িতে পানি উঠেছে। ধান-চাল সব পানির নিচ থেকে উদ্ধার করে এনেছেন, এখন শুকাচ্ছেন। পাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় তাঁদের দুই লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি এই নারীর।

মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করছিলেন প্রান্তিক কৃষক আয়নাল হক। তিনি বলেন, ‘বিছনের (বীজ) কাচলাগুলো সব নষ্ট হয়্যা গেল বাহে। বন্যা পানিত খ্যায়া গেছে। ওয়া (আমন) গাড়মু (রোপণ করা) ক্যাংকা করিয়া। আমন ধান এবার আর গাড়বার পারি না। ট্যাকা-পয়সাও নাই যে বিছন কিনিয়া আনিয়া ওয়া গাড়মু।’

ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুরের অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ওয়াপদা বাঁধে। রতনপুর চরের কৃষক ফেরদৌস আলী বলেন, বন্যার পানিতে তাঁর পাট ও ভুট্টার খেত ডুবে গেছে। এখন পানি কমলেও ফসল সব পচে গেছে। তাঁরা সরকারি সহায়তা কামনা করেন।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ বন্যায় জেলার কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে বীজতলাগুলো নষ্ট হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব কৃষকদের চাহিদামতো বীজ সরবরাহের। অন্যান্য বিষয়েও সহায়তা করা হবে কৃষকদের। তবে বন্যার কারণে যে সংকট হবে, তা পুরোপুরি পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।’