সাংসদের টাকায় খাল ভরাট

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায় শ্যামপুর খালের একাংশ ভরাট করা হয়েছে। সাংসদ মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সনের টাকায় এটি ভরাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতিও নেওয়া হয়নি।

সাংসদের পক্ষের লোকজন বলছেন, উপজেলা শহর যানজটমুক্ত করার লক্ষ্যে অটোরিকশাস্ট্যান্ড নির্মাণের উদ্দেশ্যে খালটি ভরাট করা হয়েছে। তবে অটোরিকশাচালক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, অটোস্ট্যান্ডের কথা বলে খালটি ভরাট করা হলেও সেখানে অটো ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। সাংসদকে সামনে রেখে মূলত সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এবং সতের রশি গ্রামের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম এ কাজ করেছেন। শহীদুল সেখানে বাণিজ্যিক ভবন করতে চান।

তবে শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অনেক ছোট মাপের মানুষ। আমার পক্ষে খাল ভরাটের ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয়। ইউএনও আছেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন, স্থানীয় সাংসদ আছেন। তাঁরা আমার চেয়ে অনেক ক্ষমতাধর। তাঁরাই এর জবাব দিতে পারবেন।’

জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী শফিকুর রহমান বলেন, সদরপুর সদরে জায়গার খুবই সংকট। অটোরিকশাস্ট্যান্ড করার মতো জায়গা নেই। এ জন্য ওই জায়গায় অটোরিকশাস্ট্যান্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাংসদ মজিবুর রহমানের নিজস্ব তহবিল থেকে এ টাকা জোগান দেওয়া হয়েছে।

সাংসদ মজিবুর রহমানের মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। গতকাল সোমবার বিকেলে আবার কল করা হলে তিনি সংযোগ কেটে দেন। সাংসদের সহকারী একান্ত সচিব খায়রুল বাসার বলেন, সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলার (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে রাত–দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সদরপুরে যানজট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। যানজট নিরসন করে সদরপুরকে একটি পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন সাংসদ।

এ ব্যাপারে পাউবোর ফরিদপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, সদরপুরে খাল ভরাট করে অটোরিকশাস্ট্যান্ড নির্মাণের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, খালটি ভরাটের ব্যাপারে উপজেলা সমন্বয় সভায় কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। উপজেলা শহরের যানজট নিরসনের কথা বলে সাংসদের মৌখিক নির্দেশে ওই জায়গা ভরাট করা হয়েছে। খালটির পাশের ফসল উপযোগী সমতল জমিতে (নাল) ওই স্ট্যান্ড করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে পূর্ব শ্যামপুর এলাকায় খালটির ১০০ মিটার ভরাট করা হয়েছে। পাশের ভুবনেশ্বর নদে খননযন্ত্র বসিয়ে গত মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভরাটের কাজ শুরু হয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কাজ শেষ হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩-এর ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা, কোনো জলাধারে, তীরবর্তী হোক বা না হোক, স্থাপনা নির্মাণ করে বা জলাধার ভরাট করে বা জলাধার থেকে মাটি বা বালু তুলে জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা বাধা সৃষ্টি বা গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবে না।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূরবী গোলদার বলেন, তাঁকে জানানো হয়েছিল, চরভদ্রাসন-ফরিদপুর সড়ক এবং ওই খালের মধ্যবর্তী নালের জায়গা ভরাট করে অটোরিকশাস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হবে। সে জায়গার পরিমাণ ছয় শতক। তিনি পরে জানতে পারেন, নাল জায়গা ভরাটের নামে খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

ভাসানচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভবনের কাছে ভুবনেশ্বর নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে একটি খাল শ্যামপুর হয়ে সদরপুর বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। এটি বাইশ রশি জমিদারবাড়ি ঘেঁষে ফুকুরহাটি ও মাধবপুর হয়ে ভাঙ্গার হামেরদী ইউনিয়নের মনসুরাবাদ বাজার এলাকায় কুমার নদে গিয়ে পড়েছে। এটি শ্যামপুর খাল নামে পরিচিত। এটির প্রস্থ ৬০ ফুট ও দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, এই খাল দিয়ে মানুষ নৌকায় যাতায়াত করতেন। সদরপুরের সাড়ে এগারো রশি বাজারের বিভিন্ন পণ্য এ খাল দিয়েই পরিবহন করা হতো। সারা বছর খালে পানি থাকত। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুই পারের মানুষ পাট জাগ দেওয়া, গোসল করাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে এ খালের পানি ব্যবহার করতেন।

ভাঙ্গা উপজেলার মনসুরাবাদ গ্রামের পলাশ সাহা বলেন, তাঁরা ছোটবেলায় এ খালের পানিতে গোসল করতেন ও মাছ ধরতেন। এই খাল দিয়েই নৌপথে এলাকার মানুষ পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করতেন।

১৬ জুলাই পূর্ব শ্যামপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সদরপুর সেতুর কাছে খালটির প্রায় ১০০ মিটার জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ভুবনেশ্বর নদে খননযন্ত্র বসিয়ে পাইপ দিয়ে বালু এনে খালটি ভরাট করা হয়।

শ্যামপুর এলাকার চা বিক্রেতা দলিলউদ্দিন বলেন, এমপি খালটি ভরাট করিয়েছেন। কাজ করেছেন তাঁর লোকজন। অটোরিকশাচালক শেখ দেলোয়ার বলেন, ‘অটোরিকশাস্ট্যান্ড করার কথা বলে খাল ভরাট করা হলেও ভরাটের পর ওইখানে অটো রাখতে দেওয়া হচ্ছে না। জানি না কী হচ্ছে।’