১২৬টি ঘর নির্মাণে অনিয়ম

এমনও ঘর রয়েছে, যার চারপাশে আগাছা জন্মেছে। কেউ বসবাস করছে না।
এমনও ঘর রয়েছে, যার চারপাশে আগাছা জন্মেছে। কেউ বসবাস করছে না।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ১২৬টি ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থের বিনিময়ে সচ্ছল ব্যক্তিদেরও সরকারি খরচে ঘর তুলে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার এ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ প্রকল্পে যাঁর ১ থেকে ১০ শতাংশ জমি আছে কিন্তু ঘর নেই, তাঁকে নিজ জমিতে ঘর নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থানীয় ইউপি সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা থেকে গৃহহীনদের নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এ তালিকা নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোহাম্মদ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সভাপতি, পিআইওকে সদস্যসচিব ও উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া পিআইওকে সদস্যসচিব করে ক্রয় কমিটি গঠন করা হয়।

ঘর নির্মাণের কয়েকজন উপকারভোগী জানান, এ প্রকল্পের নির্মাণাধীন অধিকাংশ ঘরে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। ঘরগুলো পোক্ত হয়নি। কাঠগুলোতে ঘুণে ধরেছে। সামান্য বাতাসে ঘর নড়বড় করে। ঘরের মেঝেতে নিম্নমানের ইট বিছানো হয়েছে। ঢালাইয়ে সিমেন্টের পরিমাণ কম দেওয়ায় মেঝেতে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তাঁরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউপি সদস্য জানান, ক্রয় কমিটিকে উপেক্ষা করে পিআইও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ঢেউটিন, কাঠ, দরজা, বাঁশ, ইট, সিমেন্ট, বালু ও জানালাসহ ঘরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কিনেছেন। এসব মালামাল নিম্নমানের। ফলে নির্মাণের কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘরের নির্মাণসামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার রূপগঞ্জ ইউনিয়নের বাগবের গ্রামের বিধবা আকলিমা বেগমের জন্য ১৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের টিনের ঘর তৈরি করা হয়। ঘরের জানালায় গ্রিল লাগানো হয়নি। জানালা ও দরজা খুবই হালকা। চৌচালা ঘরের সঙ্গে বারান্দা দেওয়া হলেও সেটিতে গ্রিল লাগানো হয়নি। ঘরটিতে ব্যবহৃত কাঠসহ অন্যান্য মালামাল নিম্নমানের হওয়ায় ঘরের খুঁটি নড়বড় করছে। ঘরের টিনগুলোও একেবারে পাতলা।

একই অবস্থা উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের বিধবা শাহিনা আক্তারের ঘরের। তাঁর চৌচালা ঘরের জানালায় কোনো গ্রিল লাগানো হয়নি।

এদিকে মুড়াপাড়া ইউনিয়নের বাড়ৈপাড় এলাকায় সরকারি জমিতে হারুন মিয়া নামের একনজনকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘরটির চারপাশ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ঘরটি তালাবন্ধ দেখা গেছে। ঘরটিতে কেউ থাকে না।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, যাঁর জমি আছে, ঘর নেই, শুধু তাঁকে ঘর দেওয়ার কথা। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ জন, যাঁদের নিজস্ব ঘর আছে, প্রকল্পের আওতায় তাঁদেরও ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি খরচে তুলে দেওয়া ঘরের বেশির ভাগই সঠিকভাবে নির্মাণ করা হয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে ক্রয় কমিটির সদস্যসচিব পিআইও আবেদ আলী বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম হয়নি। যথানিয়মেই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।’ নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প অনুযায়ী মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকা স্থানীয় সাংসদ এনেছেন। এখানে আমার করার কিছু ছিল না। গৃহহীনদের জন্য প্রকল্প হলেও যাঁর ঘর আছে, তাঁকেও ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে, এমন কেউ থাকলে থাকতে পারে। আর সরকারি জায়গায় ঘর তোলার বিষয়টি আমার জানা নেই।’

ক্রয় কমিটির সদস্য তৎকালীন রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বর্তমানে মাদারীপুরের শিবচরের ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে ইউএনওর নির্দেশে সে সময় আমরা বেশ কিছু ঘর পরিদর্শন করেছিলাম। সেখানে অনেকগুলোতে শৌচাগার ছিল না। শৌচাগার নির্মাণের জন্য বলা হয়েছিল। তবে মালামাল ক্রয়ের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। বিষয়টি কমিটির সদস্যসচিব ভালো বলতে পারবেন।’

এ বিষয়ে তৎকালীন ইউএনও, ক্রয় কমিটির সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১৭-১৮টি ঘর পরিদর্শন করেছি। সেগুলো মানসম্মত ছিল। পরে বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসি। পিআইও নিজ উদ্যোগে ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন।’

রূপগঞ্জের বর্তমান ইউএনও মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরের সংখ্যা ঠিক রয়েছে। তবে ঘরগুলো নির্মাণে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই সময় ক্রয় কমিটিকে পাশ কাটিয়ে পিআইও অন্য জেলা থেকে লোকজন এনে এই নির্মাণকাজ করেছেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সাংসদ এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক) প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’