নজরদারি নেই, হতাহত বাড়ছে

নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিক। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ১-এ ।  ছবি: প্রথম আলো
নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিক। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ১-এ । ছবি: প্রথম আলো

যাত্রাবাড়ীতে আটতলা ভবন উঠছে। বাঁশের মাচানে দাঁড়িয়ে তিনতলার বারান্দার গ্রিলের কাজ করছিলেন মো. আবুল মিয়া (৩৪)। হঠাৎ পড়ে গিয়ে বাঁশে গেঁথে যান। তারপর রাস্তায় পড়ে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে মারা যান এই নির্মাণশ্রমিক।

এক বছর আগে এই দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছিলেন আরেক নির্মাণশ্রমিক রেজাউল হোসেন। গত জুনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাচান বা বারান্দার সঙ্গে নিজেকে আটকে রাখতে আবুলকে কোনো নিরাপত্তা বেল্ট দেওয়া হয়নি। হলে আবুলকে মরতে হতো না।

গত ২৮ মার্চ সচিবালয়ে নির্মাণাধীন ২০ তলা ভবনের ১৮ তলায় কাজ করছিলেন আশরাফুল (২১)। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে তিনি তিনতলায় আটকে ছিলেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেন। আশরাফুলের পরনে নিরাপত্তা বেল্ট ছিল না। সেখানে কাজ করছিলেন তাঁর ফুফাতো ভাই রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আশরাফুলের বেল্ট ছিল কিন্তু বাঁধার মতো জায়গা ছিল না। জায়গামতো নিরাপত্তা জালও ছিল না।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্‌স) তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে বছরে গড়ে শতাধিক নির্মাণশ্রমিক কর্মস্থলে নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক শর কাছাকাছি। শ্রমিকের মৃত্যুর দিক থেকে পরিবহনের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এটি। ১১টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে হিসাবটি করেছে বিল্‌স।

এ বিষয়ে বিল্‌সের যুগ্ম মহাসচিব ওয়াজেদ-উল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, খবরে শুধু গুরুতর ঘটনাগুলো আসে। হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। নির্মাণস্থলে সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম না থাকার কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার শ্রমিকেরাও সচেতন নন। বিষয়টিতে কারও নজরদারিও নেই।

এই প্রতিবেদক ঢাকার ১০টি এলাকায় ১৫টি নির্মাণাধীন ভবন ঘুরে দেখেছেন। এলাকাগুলো হচ্ছে মিরপুরের শেওড়াপাড়া ও কালশী, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, মগবাজার, বাসাবো, বাড্ডা, কামরাঙ্গীরচর, ভাটারা ও উত্তরা। সব বাড়িতেই শ্রমিকেরা স্যান্ডেল পরে খালি মাথায় কাজ করছিলেন। চারটি বাড়ির নিচতলায় কয়েক জোড়া করে গামবুট আর প্লাস্টিকের হেলমেট রাখা ছিল। নিরাপত্তা বেল্ট ছিল মাত্র দুটি বাড়িতে।

জাতীয় শ্রমনীতি অনুযায়ী, নির্মাণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। তবে আবাসন কোম্পানি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে পড়ছে। শ্রমিক নিয়োগ করেন মূলত ঠিকাদারেরা। বিশেষ কাজের জন্য আছেন উপঠিকাদার। শ্রমিকেরা ঠিকাদার সংস্থার শ্রমিক হিসেবেই বাংলাদেশ শ্রম আইনের আওতাভুক্ত হন (০৩ ধারা)।

আইনত, শ্রমিকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ঠিকাদারের দায়িত্ব। শ্রম আইনের ৭৮ ক (১) ধারা বলছে, নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত না করে শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। মালিককেও এর নথি রাখতে হবে। আর নজরদারি করবে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) হিসাবে, দেশে নির্মাণশ্রমিকের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। আর বিল্‌সের হিসাবে, ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে ৩৭ লাখ নির্মাণশ্রমিক। পুরোনো সংগঠন ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) নেতারা বলছেন, নির্মাণ খাত বড় হচ্ছে আর দুর্ঘটনাও বাড়ছে।

সুরক্ষার আকাল

তিন বছর আগে মাদারীপুরের ছত্তার মাতুব্বর (৬০) ছাদ ঢালাইয়ের সময় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। তাঁর দুটি পা-ই কেটে ফেলতে হয়। বৃদ্ধ এখন ঢাকায় ভিক্ষা করে পরিবার চালান।

নির্মাণশ্রমিকেরা এবং নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও অঙ্গহানি ঘটে ওপর থেকে পড়ে গিয়ে, এরপর মাটিচাপায়। আরও আছে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, সেপ্‌টিক ট্যাংকের গ্যাস বিস্ফোরণ, চোখে ও মাথায় আঘাত এবং হাত-পা কাটা-ভাঙার মতো ঘটনা।

সরেজমিনে ঘুরে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কিছু বিষয় নজরে পড়ে। যেমন নির্মাণস্থলের সুরক্ষা অভাব, দুর্বল জাল বা মাচান, কপিকলের অভাব, ঝুঁকিপূর্ণ সিঁড়ি, অন্ধকার সিঁড়ি, হেলমেট-দস্তানা-বুট-বেল্ট না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইন এবং বিপজ্জনকভাবে রড-বালু-ইট রাখা। আরও আছে সুরক্ষা ছাড়া প্রচণ্ড রোদে কাজ করা বা বদ্ধ জায়গায় ঢোকা এবং সুরক্ষা ছাড়া বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। 

এ প্রতিবেদক নির্মাণশ্রমিক, ঠিকাদার, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ৫০ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, নামকরা আবাসন কোম্পানিগুলো কিছু নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেয়। তবে ব্যক্তিমালিকেরা প্রায় কিছুই দেয় না। এসবের কোনো তদারকিও নেই।

মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় গত জুনে ব্যক্তিমালিকের ব্যবস্থাপনায় একটি বাড়ির ভিত গাড়ার কাজ চলছিল। শ্রমিকেরা পায়ে মোটা পলিথিন পেঁচিয়ে হাঁটাচলা করছিলেন। তাঁদের একজন মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ে গভীর ক্ষত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, বড় কিছু আবাসন কোম্পানি বাদে কেউ এক বোতল স্যাভলনও দেয় না।

প্রশিক্ষণ ও দায়িত্বের কথা

ইনসাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলছেন, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা দরকার। সুরক্ষার জন্য সরকার আর মালিক-ঠিকাদারদের চাপ দিতে হবে।

শ্রম আইনের ৭৮ক(৩) ধারা অনুযায়ী, প্রত্যেক শ্রমিককে কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায়গুলোও শেখাতে হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের সুযোগ খুব কম।

বিল্‌স ১ হাজারের বেশি নির্মাণশ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কয়েকটি নির্মাণশ্রমিক সংগঠনের অল্পস্বল্প সচেতনতামূলক কর্মসূচি আছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও (আইএলও) কিছু প্রশিক্ষণ দেয়। সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের দক্ষতার সঙ্গে নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেয়। তবে অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ মূলত পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য।

আবাসন উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্য ১ হাজার ৫০টি কোম্পানি। রিহ্যাব গত সাত-আট মাসে ১০ হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলছেন, শ্রমিকের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে তাঁরা সদস্যদের বলেন। কিন্তু বিষয়টি তাঁদের আচরণবিধিতে নেই, নজরদারিও করেন না। নজরদারির দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।