রোহিঙ্গাদের নিয়ে অস্বস্তি স্থানীয় মানুষের

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মোছনীপাড়ার বৃষ্টিমুখর সকাল। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যেতে হাতের বাঁয়ে বড় চা দোকানে নানা বয়সী মানুষ শুক্রবারের আড্ডায় বসেছেন। কেমন আছেন—জানতে চাইলে সমস্যার ঝাঁপি খুলে বসলেন। তাঁদের সব সমস্যার মূলে নাকি শরণার্থীরা। এদের কারণে চাষবাস, মাছ ধরা, পাহাড়ে যাওয়া বন্ধ। টেকনাফ-উখিয়ার মানুষ এখন নিজ দেশে পরবাসী।

মোছনীপাড়া, ময়নারটেক ও কুতুপালং-বালুখালীর প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্থানীয় বাসিন্দাদের অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার ব্যাপারটা তাঁদের জানা। তবে তাঁদের একেকজনের প্রতিক্রিয়া একেক রকম। যেমন, মোছনীপাড়ায় মিয়ানমারের গর্জনদিয়া থেকে আসা মাজি সলামতউল্ল্যার কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি বললেন, গেরাইম্যারা (টেকনাফ-উখিয়ার মানুষ) নিজের ভাইয়ের মতো আচরণ করেছে, থাকতে দিয়েছে, খাবার ভাগ করে খেয়েছে। আবার কুতুপালংয়ের ডি ব্লকের শরণার্থীরা বললেন, তাঁদের ধারণা ‘গেরাইম্যারা’ তাঁদের হিংসা করেন। ক্যাম্পের জীবন যে আসলে ‘খঁচার মাজে কুড়ার’ (খাঁচার ভেতর থাকা মোরগের) মতো, সেটা বোঝেন না। তাঁদের অনেক সমস্যা।

যেমন, নূর কলিমার পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১২ জন। ১৫ হাত চওড়া আর ৮ হাত লম্বা ঘরে ১২ জন গাদাগাদি করে থাকেন। শৌচাগারে যেতে হাঁটতে হয় পঞ্চাশ কদম। মিয়ানমারে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আবুল কাশেমের দুঃখ, তাঁর দুই সন্তান ক্যাম্পের ভেতর লার্নিং সেন্টারে যাচ্ছে ঠিকই, দুই বছর পরও অক্ষর চেনে না। চিকিৎসাসেবা নিতে গেলে দিন পার হয়ে যায়—এ অভিযোগ নূর আমিনের। আর আলী জওহার নামের এক বৃদ্ধ বলে বসলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকে মনে করেন তাঁদের কারণে গেরাইম্যারা সুখে আছে। তাঁরা আসায় বহু লোকের চাকরি হয়েছে। তবে একবাক্যে সবাই স্বীকার করছেন, স্বাচ্ছন্দ্যে না থাকলেও স্বস্তিতে আছেন তাঁরা। মৃত্যুর ভয়ে ঘুমাতে পারতেন না, এখন আর সেই ভয় নেই। তাঁরা টেকনাফ-উখিয়ার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ।

স্থানীয় বাসিন্দা আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যৌথ মঞ্চ ইন্টার সেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) অবহিত। ২০১৯-এর যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, শরণার্থী শিবিরের ভেতরে এবং বাইরে শরণার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ক্ষোভ আছে। হয়তো শরণার্থী শিবিরের ভেতর গাদাগাদি করে থাকা এবং পড়ালেখা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ না থাকায় এসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

>

স্থানীয়দের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয়
রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ
স্থানীয় বাসিন্দা সাড়ে ৫ লাখৎ

কক্সবাজারের শরণার্থী-অধ্যুষিত এলাকার পরিবর্তন এখন খুব সহজেই বোঝা যায়। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিল, তখন পুনর্বাসন কার্যক্রম ছিল অগোছালো। এখন রাস্তার দুই ধারে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার সাইনবোর্ড। শরণার্থী শিবিরের ভেতরে এখনো মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে ব্যাগ দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রয়োজন সেখানে ছোট ছোট বাঁশের সাঁকো আছে। গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার, নারী ও শিশুবান্ধব কেন্দ্র, শিশুদের জন্য পার্ক। সে হিসেবে টেকনাফ-উখিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

টেকনাফ-উখিয়ায় এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। আর স্থানীয় বাসিন্দার সংখ্যা কম, সাড়ে পাঁচ লাখের মতো। কক্সবাজার ও টেকনাফ সদরের চাকরিজীবী মধ্যবিত্তরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরুর পর থেকে টেকনাফ-উখিয়ায় জন্মনিবন্ধন বন্ধ। উপজেলা প্রশাসনও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তাঁদের পাসপোর্ট করতেও হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দুই বছরে তাঁদের বাড়িভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে, বাজারে শাকসবজি-মাছের দাম চড়া, যাতায়াত ভাড়া বেশি।

টেকনাফের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিভাগীয় শহরে সরকারি কর্মকর্তারা যে বাড়িভাড়া পান, সেটার সমান বাড়িভাড়া হওয়া দরকার বলে তাঁরা সমন্বয় কমিটির বৈঠকে জানিয়েছেন। এখনো উত্তর পাননি। টেকনাফ-উখিয়ার বাসিন্দা কিন্তু ভাড়া বাসায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের বাড়ির মালিকেরা সাফ বলে দিচ্ছেন, পোষালে বাড়িতে উঠতে পারেন, নইলে না। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কাজের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার লোকজন আছেন শহরে। বাড়ির মালিকদের কম দামে বাসা ভাড়া দেওয়ার গরজ নেই।

শাকসবজির দাম কেমন—জানতে চাইলে টেকনাফ বাজারের শাক বিক্রেতা রশিদ আহমেদ বললেন, জিনিস অল্প, ক্রেতা বেশি। আগে যে শাক তিন বা পাঁচ টাকা আঁটি বিক্রি করেছেন, এখন সেটা ১০ টাকা। শুঁটকির দামও বাড়তি। মাছের দামও চড়া।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. হাদিউর রহমান শাকসবজির দাম বাড়ার একটা কারণের কথা জানালেন। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার উন ছি প্রাং-এ প্রতি হেক্টরে ১০ টনের মতো সবজি হতো। এতেই মোটামুটি চাহিদা মিটত এলাকার মানুষের। উন ছি প্রাং-এর সবজি উৎপাদন এখন বন্ধ। পাহাড়ি ওই জমিতে যে খালের পানি থেকে সেচ দেওয়া হতো, রোহিঙ্গা বসতি ওঠার পর সেই খালের পানিতে বর্জ্য মিশছে। সেচ দেওয়া যাচ্ছে না।

টেকনাফ ছেড়ে উখিয়ার দিকে যেতে মানুষের সমস্যার ধরন আলাদা। এখানকার মানুষের পেশা কৃষি, মাছ ধরা ও কাঠ কাটা। মোছনীতে কৃষিজমির মালিকদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের ঘর ভাড়া দিয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ৭০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ বন্ধ এখন। প্রতি হেক্টরে ধান হতো সাড়ে তিন টন। যাঁরা এসব জমিতে বর্গা চাষ করতেন, তাঁরা বেকার হয়ে গেছেন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করেছে। জেলেরাও বেকার। সৈয়দ নূর নামের একজন জেলে বলছিলেন, কাঠ কেটে, দিনমজুরি করে চলার চেষ্টা করেন। অল্প পয়সায় রোহিঙ্গা দিনমজুর পাওয়া যায়, তাই তাঁদের চাহিদা কম।

জমিতে যাঁরা ঘর তুলতে দিয়েছেন, তাঁদের একজন জাফর আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ভাড়া বাবদ তাঁর আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। কিন্তু এই লাভ তিনি ছেড়ে দিতে রাজি। তাঁর মতে, দু-এক বছর পর ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, সেটা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এই আশঙ্কা কেন—জানতে চাইলে তিনি রাস্তার উল্টো দিকের একটি মাদ্রাসা দেখালেন। ঘর তোলার জন্য দেওয়া ৪০ শতক জমিতে সেমিপাকা মাদ্রাসা হয়েছে। ভাড়া নিয়ে স্থাপনা তৈরি খুব খারাপ লক্ষণ বলে মনে করেন তিনি। জানা গেল, সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গারা মাদ্রাসার টাকা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল ওমরাহ করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকাটা পাননি। তাই মাদ্রাসার কাজটাও মনমতো হয়নি। মোস্তফা কামাল তো রোহিঙ্গা, তিনি ওমরাহ করতে সৌদি আরব কী করে গেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের এক দালালকে ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তিনিই পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়েছেন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হোস্ট কমিউনিটি বা টেকনাফ-উখিয়ার সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে, সে কারণে প্রতিটি সংস্থাকে তাদের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য ব্যয় করতে বলা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, টেকনাফ-উখিয়ার মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো জরুরি। স্থানীয় বাসিন্দারা যেন মনে না করেন যে তাঁরা কম গুরুত্ব পাচ্ছেন। তবে জন্মনিবন্ধন বন্ধ থাকা বা পাসপোর্ট করতে অসুবিধা হওয়ার জন্য তিনি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা কীভাবে জন্মনিবন্ধন কার্ড পাচ্ছেন বা বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়েছেন, সেটা তদন্ত করে বের করা জরুরি।

কথা বলে মনে হয়েছে, স্থানীয় মানুষের মনে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় জেঁকে বসেছে। স্থানীয় আবদুর রহমান বলছিলেন, নিজের এলাকায় হাঁটাচলা করতে এখন জায়গায় জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। এটা কেমন বিচার? অন্যদিকে রোহিঙ্গা তরুণ মো. সাদেকের ভাষায়, এই পরিচয়পত্রটা নেই বলেই তাঁরা দেশে থাকতে পারেননি। একবার যদি পেতেন গলায় ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটতেন।