বেসরকারি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর হিসাব অজানা

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। গতকাল রাজধানীর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে।  ছবি: প্রথম আলো
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। গতকাল রাজধানীর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা শহরের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এখন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এ রকম প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সাড়ে তিন শ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মাত্র ৩৫টি (১০ শতাংশ) প্রতিষ্ঠানে ভর্তি রোগীর তথ্য প্রকাশ করছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বিপুলসংখ্যক রোগী সরকারের হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

গতকাল প্রথম আলোর সাতজন প্রতিবেদক ২৮টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য নিয়েছেন। এসব হাসপাতালে ৫৪২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল।
এর মধ্যে অন্তত ১৬৪টি শিশু। আর সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গতকাল ঢাকাসহ সারা দেশে ২ হাজার ৯৮১ জন রোগী ভর্তি ছিল।

বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে কত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে, সেই হিসাব সরকার বা কারও কাছে নেই। সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাত্র ১৫ শতাংশ চিকিৎসা নেয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বোঝার জন্য সংখ্যাটি খুব জরুরি। এটা ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে। তিনি আরও বলেন, ‘যে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তাতে জাতীয় জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি প্রায় তৈরি হয়েছে। এটা জাতীয় দুর্যোগ।’

>

বেসরকারি চিকিৎসার চিত্র
রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসা দিচ্ছে
সরকার তথ্য দিচ্ছে ১০ শতাংশের

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘হঠাৎ রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি আমরা মোকাবিলা করছি।’ রোগীর হিসাব সম্পর্কে তিনি বলেন, তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই আন্তরিক নয়। অনেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয় না, অনেকে ঠিক সময়ে তথ্য দেয় না। তবে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালকে তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।

২৮ হাসপাতালের চিত্র
গতকাল প্রথম আলোর পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ২৮টি হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য সরকারের হিসাবে নেই। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৮টি হাসপাতালে মোট ভর্তি ছিল ৫৪২ জন। এদের অন্তত ১৫৪টিই শিশু। জুনের মাঝামাঝি থেকে রোগী আসা শুরু হলেও জুলাইয়ে বেড়ে যায়। প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকার শ্যামলীতে সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। সেখানে সব স্টাফের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। নিচতলায় বিনা মূল্যে প্রাথমিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। অধ্যক্ষের নেতৃত্বে আলাদা টিম করে এখানে কয়েকটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। রোগীর চাপ সামলাতে ডাক্তারের চেম্বার, দাপ্তরিক কয়েকটি কক্ষকে নতুন করে ওয়ার্ড বানানো হচ্ছে। বাজার থেকে তৈরি খাট ও তোশক নিয়ে এসে নতুন ২৩টি শয্যা প্রস্তুত করেছে তারা। নিজের কক্ষ ছেড়ে দিয়ে বের হওয়ার সময় অধ্যাপক জলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানবতার খাতিরে এখন ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়া সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব।

গতকাল বেলা একটায় ধানমন্ডি ৪/এ সড়কের রেনেসাঁ হাসপাতালে ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ২১টি শিশু। সেখানে ২২ জুলাই সাত বছরের এক শিশু মারা যায়। হাসপাতালটির পরিচালক (প্রশাসন) মমতাজ করিম বলেন, সরকার থেকে তাঁদের কাছে কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয়নি এবং তাঁরাও কিছু জানাননি।

ধানমন্ডির নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল ১৫ দিন ধরে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি শুরু করেছে। গতকাল পর্যন্ত এ হাসপাতালে দুটি শিশুসহ ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে। মুসা চৌধুরী নামে সাড়ে ছয় বছরের এক শিশু গত শনিবার ভর্তি হয়েছে। তার মা সালমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, চারটি হাসপাতাল ঘুরে তাঁরা এই হাসপাতালে ভর্তি করাতে পেরেছেন।

লালমাটিয়ার সিটি হাসপাতালে গতকাল ডেঙ্গু রোগী ছিল ৪২ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানানো হয়। তবে নিয়ন্ত্রণকক্ষের বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় সিটি হাসপাতালের নাম নেই। গত সপ্তাহে এই হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে।

শিশু রোগীদের জন্য নতুন করে ৩০টি পিআইসিইউ প্রস্তুত করেছে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. পারভীন ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে কিছু রোগী ফেরত দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ রোগী কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে এখানে ভর্তি হতে আসছে। তাই কোনো রোগী ফেরত না দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা হাসপাতালগুলোর মধ্যে আটটি হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নিয়মিত তথ্য দেওয়ার দাবি করেছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া তালিকায় তাদের নাম নেই। এই আটটি হাসপাতাল হচ্ছে ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, এএমজেড হাসপাতাল, বাড্ডা জেনারেল হাসপাতাল, সিটি হাসপাতাল ও সালাহউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতাল। আর নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাত্র একদিন ফোন করে তথ্য নেওয়া হয়েছিল।

ঢাকা শিশু–নবজাতক ও জেনারেল হাসপাতালে গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮টি শিশু ভর্তি ছিল। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বলেন, শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) পাঁচটি শয্যা আছে। গত দুদিনে বেশ কয়েকটি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু পিআইসিইউতে ভর্তির জন্য এসেছিল। শয্যা খালি না থাকায় ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। গত সপ্তাহে এই হাসপাতালে রশনী মণ্ডল নামে চার বছর বয়সী এক শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে।

মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন
গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেন, তাঁরা হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যে সংখ্যা পাচ্ছেন, তার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে ব্যাপক ফারাক। অধিদপ্তর বলছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে।

এ ব্যাপারে আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর মারা গেলেও মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু না–ও হতে পারে। আইইডিসিআর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পর্যালোচনা শেষে মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করে। তখন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন কতটি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করা হয়েছে? মহাপরিচালক বলেন, সভাস্থলে আইইডিসিআরের পরিচালক উপস্থিত না থাকায় এটা বলা সম্ভব নয়।

ব্রিফিং শেষে প্রথম আলোর প্রতিনিধি আইইডিসিআর কার্যালয়ে যান। আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা কতটি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করা হয়েছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
প্রথম আলো বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ পর্যন্ত ৪৬টি মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পেরেছে।

সরকারি সংখ্যায় ঘাটতি
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকা শহরের ১২টি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ২ হাজার ৬৩৯ জন রোগী ভর্তি ছিল। আর বেসরকারি ৩৫টি হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৯২০ জন।

কিন্তু ৩৫টি হাসপাতালের নাম থাকলেও ২২টি হাসপাতালের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। ২২টির মধ্যে গ্রিন লাইফ, ডেল্টাসহ প্রায় সব হাসপাতালেই গতকাল রোগী ছিল।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মোট ২৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে শিশু হাসপাতালে ১২ জন।
এই তথ্যের প্রতিবাদ করেন উপস্থিত সাংবাদিকেরা। তাঁরা বলেন, রাজধানীর প্রতিটি বড় ও মাঝারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী আছে। অনেক হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা খালি নেই। সাংবাদিকেরা বলেন, সরকারি তথ্যে ঘাটতির বড় প্রমাণ এই আইসিইউর হিসাব।