'ভালো একটা বিচার আশা করি'

কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় প্রাণ হারায় দুই শিক্ষার্থী। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় প্রাণ হারায় দুই শিক্ষার্থী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রতিদিন আসরের নামাজ পড়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান রোকসানা বেগম। গন্তব্য বাড়ির কাছের কবরস্থান। যেখানে সমাহিত আছে রোকসানার ছোট মেয়ে দিয়া খানম। মেয়ের কবরের দিকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকেন রোকসানা। কখনো মেয়ের শোকে নীরবে চোখের জল ফেলেন। মাগরিবের আজান পড়লে ঘরে ফেরেন সন্তানহারা এই মা।

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় মারা যায় দিয়া খানম (মীম)। দিয়া শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। ওই দুর্ঘটনায় একই কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীবও মারা যায়।

সেই ঘটনার আজ এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। দিয়া ও রাজীবের মায়ের আকুতি—এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক। যাতে আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।

গত শনিবার দুপুরে মহাখালী দক্ষিণপাড়া এলাকায় দিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বসার ঘরে দিয়ার একটি ছবি। কলেজের পোশাক পরে স্মিত হাসি দিয়ে ছবিটি তুলেছিল দিয়া। ছবির সামনে তার কলেজের পরিচয়পত্রটি রাখা।

শোবার কক্ষের বিছানার এক কোনায় বসে ছিলেন রোকসানা বেগম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। দিয়ার কথা বলতে চাইলেন কিন্তু আওয়াজ বের হতে চাইছিল না। একসময় অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘ভালো একটা বিচার আশা করি।’

‘স্কুলে থাকতে আমি নিজেই মেয়েকে আনা-নেওয়া করতাম। একা ছাড়তাম না। কলেজের শুরুর দিকেও সঙ্গে যেতাম। কখনো ভাবি নাই মেয়ে আমার কলেজ থেকে আর ফিরবে না’—রোকসানা বেগম আপনমনে বলতে থাকেন। রোকসানা বেগমের আফসোস, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নেই।

>

দিয়া ও রাজীবের পরিবার
গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মারা যান দিয়া খানম ও আবদুল করিম রাজীব

ঘরে দিয়ার অনেকগুলো ছবি। কোনো ছবিতে বাবা-মায়ের পাশে দিয়া। কোনোটিতে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঘরের একটি শোকেজের নিচের তাকে দিয়ার ব্যবহৃত কলেজের সাদা কেডস, মাথার ক্যাপ। আরেক তাকে দিয়ার বই ও ব্যবহারিক খাতা। মুঠোফোন, ছাতাসহ দিয়ার অন্য জিনিসপত্রও রাখা।

দিয়ারা পিঠাপিঠি দুই বোন। দিয়ার এক বছরের বড় রোকেয়া খানম রিয়া এবার এইচএসসি পাস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘দুই বোন অনেক গল্প করতাম। এখন কথা বলতে ভালো লাগে না। গত এক বছরে জীবন অনেক বদলে গেছে’—বোনের কথা বলতে গিয়ে রোকেয়ার চোখ ভিজে যায়। ছবি দেখিয়ে রোকেয়া বলল, দিয়া ক্যাপ পরতে খুব পছন্দ করত।

বোনকে হারানোর পর অনেক কেঁদেছিল দিয়ার ছোট ভাই রিয়াদুল ইসলাম ওরফে আরাফাত। রিয়াদুল এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। বোনকে হারানোর পর চঞ্চলতায় ভরপুর রিয়াদুলও এখন চুপচাপ।

দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিজেও বাসচালক ছিলেন। বাসচাপায় মেয়ে মারা যাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেন, আর কখনো বাসের স্টিয়ারিং হাতে নেবেন না। জাহাঙ্গীর এখন বাড়ির কাছেই একটি দোকানে বসেন। দুর্ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। ‘আমার মেয়েটা ওয়ালের সাথে চাইপা গিয়াও বাঁচতে পারে নাই’—এখনো মেয়ের মারা যাওয়ার দৃশ্য ভুলতে পারেন না জাহাঙ্গীর।

নিজের মেয়ের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা মানতে রাজি না জাহাঙ্গীর। তাঁর মতে, ‘১০-১৫  হাজার টাকা খাইয়া বিআরটিএ যারে-তারে লাইসেন্স দিয়া দেয়। ড্রাইভারদের মানুষের প্রতি কোনো দয়ামায়া নাই। একটা যাত্রী তোলার জন্য পাল্লাপাল্লি করে। আর ছেলেমেয়ে হারায় আমার মতো কত বাপ-মা রাস্তায় রাস্তায় কান্দে।’

দিয়া-রাজীবের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের পরেও সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরায় ক্ষুব্ধ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরে রাস্তায় কিছুটা সৌন্দর্য আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন আবার সেই খামখেয়ালি, ত্যাড়াব্যাঁকা চালানো হচ্ছে। গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে আসে নাই।’

২৯ জুলাই বাসের চাপায় মারা যাওয়া আরেক শিক্ষার্থী রাজীব থাকতেন আশকোনায় খালার বাসায়। রাজীবের বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। মা মহিমা থাকেন নোয়াখালীর হাতিয়ায়। রাজীবকে দাফন করা হয়েছে হাতিয়াতে। রাজীবের মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়।

রাজীবরা চার ভাইবোন। রাজীবের দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তাঁরা ঢাকায় থাকেন। ছোট ভাই আল-আমিন বড় বোনের বাসায় থেকে একটি স্কুলে পড়ে। হাতিয়ায় মহিমার সময় কাটে ছেলের স্মৃতি রোমন্থন করে। মহিমা বলেন, ‘বড় ছেলে রাজীব মেধাবী ছিল। কষ্ট কইরা পড়ালেখা করাইছিলাম। ওর ছোট খালা ঢাকায় নিছিল কলেজে পড়াবে বইলা। কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝলাম না। ছেলের জিনিসপত্র দেখি আর রাত-দিন কান্দি।’