কিছু ক্ষতিপূরণ পেতেও লোক লাগে

নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিকেরা। সম্প্রতি রাজধানীর  আগারগাঁও এলাকায়।  ছবি: আশরাফুল আলম
নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিকেরা। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায়। ছবি: আশরাফুল আলম

কর্মস্থলে নির্মাণশ্রমিক নিহত বা আহত হলে মালিক আর ঠিকাদারের লোকজন তাৎক্ষণিক কিছু টাকাপয়সা দিয়ে ঝামেলা মেটাতে চান। চাপ দিলে বা ধরাধরির লোক থাকলে কিছু ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। তবে সেটা নিতান্তই অপ্রতুল, বলছেন শ্রমিক আন্দোলনকর্মীরা।

নির্মাণশ্রমিক মো. জহির ফকির ২০১৫ সালে রাজধানীর বাসাবোর একটি ভবনের তৃতীয় তলা থেকে মাচান ভেঙে নিচে পড়ে যান। তাঁর বাঁ পা ভেঙে যায়। এখন ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর ঠিকাদার ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তিনি জমি বিক্রি করে, শ্বশুরবাড়ির সাহায্য নিয়ে চিকিৎসায় ৪ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছেন। এখন সংসার চলছে ঋণ করে।

বাংলাদেশ নির্মাণ শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ বি সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, হতাহত শ্রমিকদের পক্ষে প্রভাবশালী লোক না থাকলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় না। তবে একজোট হয়ে মামলার ভয় দেখালে কিছু কাজ হয়।

বাগেরহাটের সবুজ সরদার রাজধানীর দনিয়ায় কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গত অক্টোবরে মারা যান। ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) ভবনমালিকের সঙ্গে দেনদরবার করে তাঁর পরিবারকে ১ লাখ টাকা পাইয়ে দেয়।

আদায়ের কঠিন পথ

শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব মালিকের। নির্মাণশ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই মালিক হচ্ছেন ঠিকাদার। তবে কোনো ঝামেলা হলে নির্মাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব বর্তাবে। নজরদারির দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের।

নিয়ম অনুযায়ী, দুর্ঘটনা হলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ওই কলকারখানা-প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন। ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য অধিদপ্তর প্রয়োজনে মামলা করবে। অধিদপ্তর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেড় হাজারের বেশি মামলা করেছে। তবে এর কতগুলো নির্মাণ খাতের জন্য, সে হিসাব নেই।

>

ক্ষতিপূরণের আইন কেউ মানে না
শ্রমিক বা পরিবার এ সম্পর্কে জানে না
সরকারি কর্তৃপক্ষ উদাসীন

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্‌স) পরামর্শক খন্দকার আ. সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণ আদায়ে অনিয়ম ও বঞ্চনার কারণ সরকারি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব। তাঁরা সব সময় পরিদর্শন করেন না, প্রতিবেদনে মালিকপক্ষের সাফাই গান। অনেক সময় আইনি সহায়তাও দেন না।

তবে অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বলছেন, এখন ক্ষতিপূরণ ভালো আদায় হচ্ছে। বেশি পাচ্ছেন পোশাকশ্রমিকেরা। নির্মাণ খাতে হতাহত শ্রমিকদের জন্য করা মামলার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা তিনি বলতে পারেননি।

প্রথম আলো ১০ জন আহত শ্রমিক ও ১০ জন নিহত শ্রমিকের স্বজন, দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ২০ জন শ্রমিক এবং নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্ট ১০ জন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তাতে নানা রকম বঞ্চনার চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

ক্ষতিপূরণের সাতকাহন

গত জানুয়ারিতে উত্তরায় কাজ করার সময় আঘাত পান মাসুম ফকির (৩২)। পরে তাঁর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল কেটে ফেলতে হয়। তিনি বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ দূরের কথা, হাসপাতালের খরচও পাইনি।’ প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, ছোটখাটো দুর্ঘটনায় কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। চিকিৎসা নিজের খরচে করাতে হয়।

তবে শ্রমিক মারা গেলে মালিক বা ঠিকাদার লাশ বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, দাফন ও কুলখানির খরচ মিটিয়ে থাকেন। সেটা ২০-৩০ হাজার টাকার মতো। ধরাধরির লোক থাকলে নামী আবাসন কোম্পানিগুলো আইন অনুযায়ীই ক্ষতিপূরণ দেয়। ব্যক্তিমালিকেরা বেশির ভাগ সময় নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেন।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) অনেক সময় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি মধ্যস্থতা করে। সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, আবাসন বা ঠিকাদার কোম্পানির উচিত শ্রমিককে বিমার আওতায় আনা।

নির্মাণশ্রমিক বা তাঁদের পরিবার অনেক সময়ই ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে সচেতন নয়। ২০১৮ সালের মে মাসে মগবাজারের একটি বাড়িতে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান জামাল উদ্দিন। ঠিকাদার দ্রুত এক শ্রমিকের জিম্মায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া আর ১০ হাজার টাকাসহ লাশ লালমনিরহাটে জামালের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। গত জুনে কথা হয় জামালের মা রাহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হায়াৎ শেষ হইছে, আল্লাহ নিয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ দিবো ক্যান।’ 

বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন শ্রমিক বলেছেন, বিপর্যস্ত স্বজনের মাথায় ক্ষতিপূরণের কথা আসে না। নির্মাণশ্রমিক মিরপুরের সেলিম হোসেন বলেন, দুই বছর আগে তাঁর এক সহকর্মী আহত হয়েছিলেন। ক্ষতিপূরণের জন্য চাপ দিলে পরে তাঁকেই চোর সাব্যস্ত করা হয়।

মামলায় বাধা, সমাধান কী

একাধিক শ্রমিকনেতা এবং তিনটি আইন সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আইনজীবীরা বলেছেন, ভুক্তভোগীপক্ষ মামলায় আগ্রহী নয়। বেশ কয়েকজন আহত শ্রমিক ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলার কথা তাঁরা জানেন না। নগদ যা পান, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন।

গত বছর জুনে নওগাঁয় দোতলা থেকে মাচান ভেঙে পড়ে গিয়ে সাইফুল ইসলামের ডান পা ভেঙে যায়। তাঁর চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ভবনমালিক দিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা। কেন মামলা করেননি? সাইফুলের উত্তর, ‘লেহাপড়া জানি না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নাই।’

মামলা করার ক্ষেত্রে বড় বাধা অপ্রাতিষ্ঠানিক এই খাতে শ্রমিকের নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র না থাকা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নওশীন শাহ মনে করেন, নির্মাণ খাতকে এখন প্রাতিষ্ঠানিক গণ্য করার সময় হয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিককে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন দিতে হবে। পাশাপাশি হতাহত শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।  (শেষ)