গানে গানে রোহিঙ্গা শিল্পী হাবিবুরের 'কষ্ট'

কুতুপালং-বালুখালী শরণার্থীশিবিরে শরণার্থীর সংখ্যা ৬ লাখের ওপর। এত এত মানুষের ভিড়ে ম্যান্ডোলিনবাদক হাবিবুর রহমানকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সে নিয়ে সংশয়ই ছিল। তবে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। পাহাড়ের বেশ উঁচুতে দাঁড়িয়ে যখন হাবিবুরের খোঁজ করা হলো, তাঁর বাড়ি দেখিয়ে দিতে অনেকেই আগ্রহী হলেন। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে পাওয়া গেল শিল্পীকে। প্রথম আলোর জন্য তিনি গত শুক্রবার গেয়ে শোনালেন তাঁর স্বরচিত একটি গান।

হাবিবুর রহমান ছোটবেলা থেকেই গানপাগল। নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন ওস্তাদকে। মিয়ানমারে ওস্তাদ শামসুল হকের কাছ থেকে ম্যান্ডোলিন বাজানো শিখে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্মানীর বিনিময়ে বাজাতেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন বেশি। এক এক আসরে বাজিয়ে তাঁর রোজগার ছিল বাংলাদেশি টাকায় ছয়-সাত হাজারের মতো। এখনো বাজান তিনি। কক্সবাজারে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ডাকে গানবাজনা করেন। তিনি যেমন ম্যান্ডোলিন বাজাতে শিখেছিলেন ওস্তাদের কাছে, তেমনি নিজেও শিখিয়েছেন আরও চারজনকে। আশা রাখেন, তাঁর শিষ্যরাও অনুপ্রাণিত করবে অন্যদের।

শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হাবিবুর রহমান থাকেন ছোট্ট একটা খুপরিতে। আশা করেন, একদিন নিজের দেশে ফিরবেন। শুক্রবার তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা গেল, হাবিবুর রহমান স্ত্রী হাজেরা বেগমকে নিয়ে ইট-বালু-সিমেন্ট দিয়ে ঘর মেরামতের কাজ করছেন। অন্ধকার ঘর, তবে মাথার ওপরে শিল্পীকন্যা কাগজের ফুল দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেছে। সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করলে জানতে চাইলেন, এটা কবে কোথায় প্রচারিত হবে। তারপর গায়ে একটা ফুলহাতা শার্ট গলিয়ে গাইতে বসলেন প্রথম আলোর জন্য।

হাবিবুর রহমান যে গানটি করলেন, তার অর্থ বাংলায় এমন, আরাকানের রোহিঙ্গা যারা, তাঁরা ঘরবাড়িছাড়া, নির্যাতিত। এই চড়ুই পাখির মতো গরিব বসতিতে থেকে রোহিঙ্গাদের কী গতি হবে। আল্লাহ সমতলের মোরগ বানিয়ে আর কত দিন রাখবে? মক্কা শরিফে এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের বলি মিয়ানমারে আমরা কিছু কষ্ট পেয়েছি, শরণার্থীশিবিরেও কিছু কষ্ট আছে। রোহিঙ্গাদের মনে অনেক কষ্ট। ছোট ছোট দুধের শিশুকে মার কোল থেকে নিয়ে ছুড়ে ফেলেছে। তারা দুধের জন্য চিৎকার করেছে। রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছাড়া, নির্যাতিত। বাংলাদেশের সরকার না থাকলে রোহিঙ্গারা কোথায় স্থান পেত? এই সরকারের মনে বেশি বেশি দয়া। তারাই রোহিঙ্গাদের রেখেছে। রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছাড়া, নির্যাতনের শিকার।

হাবিবুরের পুরো গানটি তুলে দেওয়া হলো:

আরকান নর রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া,
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।
আরকান নর রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া,
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।

এ রোহিঙ্গার অইবো হন গতি,
পিঁয়াইজ্জার মতো গরির বসতি।
এ রোহিঙ্গার অইবো হন গতি,
পিঁয়াইজ্জার মতো গরির বসতি।
সমতলর কুঁড়া বানাই,
সমতলর কুঁড়া বানাই,
ও আল্লা আর কতদিন রাকিবা।
ও আল্লা আর কতদিন রাকিবা।
আরকান নর রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া।
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।

মক্কা শরিফ আছে এহন যাঁরা,
আল্লার হেরাম ধরি মাগো তোয়ারা।
মক্কা শরিফ আছে এহন যাঁরা,
আল্লার হেরাম ধরি মাগো তোয়ারা।
কেচ্ছু দুঃখ পাইর আরকানত,
কেচ্ছু দুঃখ পাইর আরকানত,
আর কেচ্ছু দুঃখ পাইর বাংলাদেশের কেম্পত।
বেশি চিন্তা আছে রোহিঙ্গার মনত,
বেশি চিন্তা আছে রোহিঙ্গার মনত।
আরকান দেশত রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া।
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।

গুঁড়া গুঁড়া দুধের জাদু দরি,
মার কোলত তুন ল ফেললে হাঁড়ি,
গুঁড়া গুঁড়া দুধের জাদু দরি,
মার কোলত তুন ল ফেললে হাঁড়ি,
কোলর পোয়া উইট টে খিঁচখিঁচাই,
কোলর পোয়া উইট টে খিঁচখিঁচাই।
আদরজ্জা মার দুধর বাট ন পাই,
আদরজ্জা মার দুধর বাট ন পাই।
আরকান নর রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া,
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।

ন থাকিত এ বাংলা সরকার
এ রোহিঙ্গা হড়ে পাই তো স্থান,
ন থাকিত এ বাংলা সরকার
এ রোহিঙ্গা হড়ে পাই তো স্থান।
আল্লার বেশি রহমত
বাংলা সরকারের মনত।
এ রোহিঙ্গা রে রাইককে দে স্থান দেই,
এ রোহিঙ্গা রে রাইককে দে স্থান দেই।
আরকান নর রোহিঙ্গা যাঁরা,
অইগিলাম গই ঘরবাড়িছাড়া।
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।
অইগিলাম গই নিযার্তন ছাড়া।