ডিআইজি প্রিজনস পার্থ থাকেন শাশুড়ির ফ্ল্যাটে, চড়েন বন্ধুর গাড়িতে!

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হওয়া কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিক থাকেন থাকেন শাশুড়ির ফ্ল্যাটে, চড়েন বন্ধুর গাড়িতে। দুদকের কাছে এমন তথ্য দেন তিনি নিজে।

তবে বাসা থেকে জব্দ ৮০ লাখ টাকা তাঁর নিজের বলে জানিয়েছেন আদালতকে। বেতন-ভাতার টাকা জমিয়ে এই টাকা হয়েছে তাঁর। তবে এই টাকার তথ্য তাঁর আইনজীবী ভুলে আয়কর নথিতে দেখাননি বলে তাঁর দাবি।

দুদক সূত্র বলছে, ডিআইজি পার্থ কলাবাগানে যে বাসায় থাকেন, সেটি তাঁর শাশুড়ি মঞ্জু সাহার নামে কেনা। পার্থর দাবি, বাড়িটি তাঁর শ্যালিকা কিনে দিয়েছেন। তবে ফ্ল্যাট বাড়িটির মালিক দুদককে নিশ্চিত করেছেন, বাড়িটি কিনেছেন ডিআইজি নিজেই। সূত্র জানায়, ডিআইজি প্রিজন পার্থর পরিবার যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটি তাঁর এক বন্ধুর নামে। আর নিকেতনে একটি ফ্ল্যাট আছে পার্থর মায়ের নামে। দুদকের অভিযানের শুরুতে জব্দ করা টাকার মধ্যে ৩০ লাখ টাকাও তাঁর শাশুড়ির বলে দাবি করেছিলেন ডিআইজি। ব্যাংক থেকে উঠিয়ে সেগুলো বাসায় রাখা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এ–সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি।

গতকাল রোববার রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় পার্থ গোপাল বণিকের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে দুদক। আজ সোমবার তাঁকে আদালতে নেওয়া হলে আদালত তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। মামলার এজাহারে পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে বৈধ পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত হিসেবে ঘুষ গ্রহণ করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন, অর্থের অবস্থান গোপন ও পাচারের উদ্দেশ্যে নিজের বাসায় লুকিয়ে রাখার অভিযোগ আনা হয়।

পার্থ গোপাল বণিকের বাসা থেকে টাকা উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে শুরুতেই ভাবনায় ছিল না দুদকের। তাঁদের কাছে তেমন তথ্যও ছিল না। দুদক তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তলব করেছিল। দুদক সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে নিজের কথাতেই ধরা পড়ে যান পার্থ গোপাল বণিক। অনুসন্ধান দল নিশ্চিত হয়ে যায় তাঁর বাসায় টাকা থাকার বিষয়ে। তারপরই রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকার ভূতের গলির একটি বাড়ির সাততলায় পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দুদক ওই অভিযান চালায়। অভিযান সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পার্থ গোপালকে সকাল ১০টা থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি বলেন, ব্যাংকে তাঁর কোনো টাকা নেই। দুদকের কাছে থাকা কাগজপত্রে সেটার সত্যতা পাওয়া যায়। তখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁর টাকা কোথায় রাখা আছে। তিনি জানান, একটি ব্যাংকের ভল্টে রাখা আছে। দুদক দল সেখানে গিয়ে যাচাই করার কথা বললে তিনি তখন কথা ঘুরিয়ে নেন। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তাঁর বাসাতেই টাকা আছে। শুরুতে ২০ বা ৩০ লাখ টাকার কথা বললেও একপর্যায়ে ৮০ লাখ টাকা বাসায় গচ্ছিত আছে বলে স্বীকার করেন।

তাঁর তথ্য অনুযায়ীই দুদক দল তাঁর বাসায় গিয়ে ওই টাকা উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার নানা টানাপোড়েনের পর বাসার দরজা খুলে দেন পার্থর চিকিৎসক স্ত্রী রতনমনি সাহা। ঘরে ঢুকেই বাসার ড্রয়িংরুমের দক্ষিণ পাশের শোওয়ার ঘরের দেয়াল কেবিনেট থেকে গামছার ভেতরে থাকা হলুদ গেঞ্জি দিয়ে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের করে দেন। এরপর ডিআইজি প্রিজন তাঁর স্ত্রীর কাছে আরেকটি প্যাকেটের বিষয়ে জানতে চান। তাঁর স্ত্রী সে রকম কোনো প্যাকেট নেই বলে জানান। পরে জানা যায়, ওই প্যাকেটটিই তিনি পাশের ভবনের ছাদে ফেলে দিয়েছিলেন।

পার্থ গোপাল বণিক আদালতের কাছে দাবি করেন, তাঁর বাসা থেকে দুদক যে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে, সেটা তাঁর নিজের। এই টাকা বেতন-ভাতার। আদালত তখন তাঁর কাছে এ টাকার উৎস জানতে চান। জবাবে পার্থ বলেন, ৩৯ লাখ টাকা তাঁর সঞ্চয়পত্রের টাকা। এই টাকা তিনি পোস্ট অফিস থেকে তুলেছেন। আদালত তখন জানতে চান, এই টাকা আপনি কি আপনার আয়কর বিবরণীতে দেখিয়েছেন? জবাবে পার্থ বণিক বলেন, এই টাকা আয়কর বিবরণীতে দেখানো হয়নি। তাঁর আইনজীবী ভুলবশত এ টাকা আয়করে দেখাননি।

পার্থ গোপাল বণিকের আইনজীবী আবদুর রহমান হাওলাদার আদালতকে বলেন, দুদক যে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করেছে, তা পার্থ বণিকেরই টাকা। এই টাকা সম্পূর্ণ বৈধ টাকা। পার্থ বণিকের ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বৈধ টাকা। বাকি টাকা তাঁর মা এবং শাশুড়ির সঞ্চয়পত্রের টাকা। বৈধ এই টাকা ফ্ল্যাট কেনার জন্য রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে দুদক।

তবে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, দুদক পার্থ গোপাল বণিকের বাসা থেকে যে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে, তা ঘুষের টাকা, অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা। পার্থ গোপাল বণিক একজন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর বছরে আয় ৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান চলছে। তল্লাশি চালিয়ে তাঁর বাসা থেকে অবৈধভাবে উপার্জিত ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।