হাটের ঝক্কি এড়াতে খামারেই গরু কেনা

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় সাদিক অ্যাগ্রো নামের খামারে গরুকে আদর করছেন একজন কর্মী। আদর পেতে গরুটিও মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় সাদিক অ্যাগ্রো নামের খামারে গরুকে আদর করছেন একজন কর্মী। আদর পেতে গরুটিও মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

হাটে হাজারো মানুষ ভিড়ভাট্টা, গবাদিপশুর সারি কিংবা বর্ষার কাদাপানি ভেঙে কোরবানির পশু বাছাইয়ের ঝক্কি নেই। নেই দালাল কিংবা পকেটমারের চক্করে পড়ে সব খোয়ানোর শঙ্কা। বরং ছিমছাম ‘ঘরোয়া’ পরিবেশে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পছন্দের পশু কেনার চমৎকার বন্দোবস্ত রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ চারপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা খামারগুলোতে। এই খামারিদের বেশির ভাগ কেবল মাংসের জন্য বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু লালনপালন করেন।

ঢাকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর ধরেই ঈদুল আজহা সামনে রেখে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে গরুর খামারের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর ঢাকার সূত্রাপুর, তেজগাঁও, লালবাগ, মোহাম্মদপুরসহ সাভার, ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ এবং দোহারে গড়ে ওঠা ২ হাজার ৬৮০টি খামারে কোরবানিযোগ্য ১৬ হাজার ৭২৮টি গবাদিপশু আছে। এর মধ্যে ষাঁড় আছে ১৪ হাজার ৯৩৭ টি, বলদ ১ হাজার ৩৯৩ টি। গাভির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শ। এ ছাড়া ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ১৩৭ ও ১৯১ টি। আছে ৪০ টির মতো মহিষ।

গতকাল সোমবার রাজধানীর পশ্চিম অংশে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় এমন দুটি খামার ঘুরে দেখা যায়, খামারিরা ঢাকায় নিজস্ব খামারেই গবাদিপশু লালনপালন করেন। এই দুই খামারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশের নিয়মিত খামারিরা সাধারণত তাঁদের পশু বিক্রির জন্য হাটে তোলেন না। বিজ্ঞাপন, ফেসবুকে প্রচারসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ক্রেতাদের খামার থেকেই গরু কিনতে আকৃষ্ট করেন। ক্রেতারা একাধিকবার খামারে এসে পশু পছন্দ করতে পারেন। অনেকে আগাম বুকিং করে যান পছন্দের গরু। কেনার পর কোনো পশু অসুস্থ হয়ে পড়েলে তা বদলে দেওয়ার ব্যবস্থাও রেখেছেন অনেক খামারি। এসব বিবেচনায় অনেকেই হাটের বদলে এসব খামার থেকে পশু কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন।

গতকাল মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো নামের একটি খামারে কথা হয় মিরপুরের শাকিল আহমেদ নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। খামারে কোরবানির জন্য গরু দেখতে এসে প্রথম দিনেই তিনি একসঙ্গে দুটি গরু কিনেছেন। এর একটির দাম পড়েছে ৯৫ হাজার ৬২৫ টাকা। অন্যটি ১ লাখ ২ হাজার টাকা। তিনি জানান, এই খামারে ৪০০ কেজি ওজনের নিচে যে গরুগুলো আছে তার কেজিপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ৩৭৫ টাকা করে। সে হিসেবে তিনি ২৫৫ কেজি ও ২৭২ কেজি ওজনের দুটি গরুর দাম পরিশোধ করেছেন।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সাধারণত ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি ওজনের গরুর ক্ষেত্রে দাম প্রতি কেজি ৪২৫-৪৫০ টাকা। ৬০০ কেজির মধ্যে ৪৭৫ টাকা কেজি। এর বেশি ওজনের গরুর দাম ঠিক হয় দরদাম করে।

হাটের বদলে খামার থেকে গরু কেনার কারণ জানতে চাইলে পেশায় ব্যবসায়ী শাকিল আহমেদ বলেন, হাট থেকে কোরবানির পশু কেনার চেয়ে খামার থেকে কেনায় ঝক্কি–ঝামেলা অনেক কম। তা ছাড়া একটা নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়। যেমন কিনে নেওয়া গরু অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটি আবার বদলে দেওয়ার কথা বলেছেন খামারের ব্যবস্থাপক। হাটে তো এই সুবিধা পাওয়া যাবে না। আর ঈদের আগের দিন খামারি নিজেই গরু বাসায় পৌঁছে দেবেন। এ ক্ষেত্রে ঝামেলা আরও কমে গেল।

>

ঢাকা ও আশপাশে আড়াই হাজারের বেশি ছোট–বড় খামার গড়ে উঠেছে
এবার এসব খামারে কোরবানির জন্য পশু আছে ১৬ হাজার ৭২৮ টি

সাদিক অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শরিফের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা এক যুগের বেশি সময় ধরে পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত। কোরবানি ঈদ উপলক্ষে তাঁরা সারা বছর নিজস্ব খামারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের গরু-ছাগল, দুম্বা এমনকি মহিষও পালন করেন। পাশাপাশি সিন্ধি, শাহিওয়ালের মতো কয়েকটি জাতের গরু ভারত থেকেও আমদানি করেন। এই খামারের গরুগুলোর দাম শুরু হয়েছে ৮০ হাজার টাকা থেকে। তবে এবার এর মধ্যেই ৩৭ লাখ টাকায় ব্রাহমা জাতের একটা ষাঁড় বিক্রি করেছেন তাঁরা।

জানা গেল, ৯০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে এখানে পাওয়া যাবে ভুটান থেকে আমদানি করা ছোটখাটো গড়নের ‘ভুট্টি’ গরু। আছে দেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল, যমুনাপাড়ি, বিটলসহ কয়েক প্রজাতির ছাগল। এ ছাড়া খামারে পালিত দুটি ‘বিড়ালচোখা’ পাকিস্তানি জাতের মহিষ বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে সাড়ে তিন লাখ ও সাড়ে চার লাখ টাকায়।

সাদিক অ্যাগ্রোর পাশেই অরগ্যানিক ডেইরি অ্যান্ড অ্যাগ্রোভেট নামের আরেকটি খামারে কথা হলো ব্যবস্থাপক আহাদ আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, আগে তাঁদের খামারে বেশির ভাগই ছিল গাভি। কিন্তু দুধের তুলনায় মাংস উৎপাদনের বিষয়টি বেশি লাভজনক হওয়ায় তাঁরা এখন সেখান থেকে সরে এসেছেন। তরুণ এই খামারি বলেন, ‘কোরবানি সামনে রেখে এই বছর আমরা ৪০টি ষাঁড় বড় করেছি। এর মধ্যে ২৫টিই বিক্রি হয়ে গেছে। ষাঁড়ের দাম শুরু হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে। খামারের ফ্রিজিয়ান জাতের সবচেয়ে বড় ষাঁড়টির ওজন ১ হাজার ২০০ কেজি। দাম চাওয়া হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা।’

ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা এ রকম খামারের বিষয়ে কথা হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (খামার) এ বি এম খালেদুজ্জামানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার আওতায় পশুর খামার পরিচালনা করতে পারলে তা খুব দ্রুত লাভজনক হয়ে ওঠে। আর আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য কোরবানির ঈদ একটা বড় উপলক্ষ। গত কয়েক বছরে ভারত থেকে আমদানি করা গরুর সখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসায় খামারিরা এখন কোরবানির মৌসুমে ভালো দাম পাচ্ছেন। বছর বছর এই খাতে আগ্রহী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ার এটা একটা বড় কারণ।