সিঙ্গাইরে গুদামে চাল দেন ফড়িয়ারা

খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী মিলমালিকদের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের পর ছাঁটাই করে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করার কথা। তবে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। এ ছাড়া মিলমালিকেরা নন, বাইরে থেকে চাল কিনে খাদ্যগুদামে দিচ্ছেন স্থানীয় ফড়িয়ারা। এসব ফড়িয়ার মধ্যে আছেন যুবলীগের নেতারাও।

অভিযোগ রয়েছে, খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য বিভাগকে ‘ম্যানেজ’ করে অন্য জেলা থেকে অটোরাইস মিলের চাল কিনে সরাসরি গুদামে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি চাল সরবরাহ নিয়ে ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে এমন অসংগতি এবং অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানেও চাল সংগ্রহে অনিয়ম পাওয়া গেছে।

গত ৩০ মে ইউএনওর পাঠানো ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮-১৯ মৌসুমে উপজেলার সরকারি গুদামে চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। উপজেলায় যে তিনটি চালকলের মাধ্যমে ৬৪৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের কথা, বাস্তবে এসব মিলের মাধ্যমে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়। চালকলগুলো সচল নেই। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকলের সক্ষমতা ও অবকাঠামো অনুযায়ী, উল্লিখিত পরিমাণ চাল সংগ্রহ করতে অক্ষম ওই চালকলগুলো।

ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ খাদ্যগুদামে চাল সংগ্রহের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, সরেজমিন ও মিলারদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, বরাদ্দকৃত চাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ না করে তাঁরা দিনাজপুর থেকে ক্রয় করে উপজেলা খাদ্যগুদামে সরবরাহ করেছেন। এই অনিয়মে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। দিনাজপুরের অটোরাইস মিল থেকে আনা ২৯২ মেট্রিক টন চাল উপজেলা খাদ্যগুদামে মজুত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত ২০ মে উপজেলা খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করেন তিনি। সে সময় তিনি খাদ্যশস্যের হিসাবে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখতে পান। গত বছরের ভিজিডির জন্য সংগৃহীত আমন, বোরো এবং চলতি বছরের জন্য সংগৃহীত বোরোর কোনো হালনাগাদ তথ্য ছিল না, যা দেখে খাদ্যশস্যের মজুত মেলানো সম্ভব।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার উপজেলার তিনটি মিল থেকে ৬৪৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার কথা। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত এসব মিলগুলো হচ্ছে উপজেলার গোবিন্দল ইউনিয়নের ডুবাইল গ্রামের হাসেন আলী রাইস মিল, চারিগ্রাম ইউনিয়নের জাইল্যা গ্রামের আরিফ রাইস মিল এবং বায়রা ইউনিয়নের বায়রা বাজার এলাকার খান রাইস মিল।

সম্প্রতি হাসেন আলী রাইস মিলে গিয়ে দেখা যায়, মালিক লিটন মিয়া তাঁর ছোট পরিসরের মিলটিতে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির ধান ভাঙাচ্ছেন। মিলে ধান ভেজানোর ব্যবস্থা নেই। ধান সেদ্ধ করার কোনো বয়লারও নেই। তাঁর মিলের অনুকূলে খাদ্য বিভাগ থেকে কী পরিমাণ চাল সরবরাহের বরাদ্দ পেয়েছেন—জানতে চাইলে লিটন মিয়া বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এ সময় সহযোগীকে নিয়ে সিঙ্গাইর সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক সেখানে হাজির হন। তিনি বলেন, তিনিই মিলটি চালান। খাদ্যগুদামে তিনিই চাল দেন। 

মিলটির লাইসেন্স নেওয়ার সময় উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে মিলের মালিক লিটন মিয়ার নামে যে মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটি খালেকের ব্যক্তিগত। 

একই দিন সরেজমিনে বায়রা বাজারে খান রাইস মিলটিকে জরাজীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়। মিলটির কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান। রাইস মিলটির মালিক হাফিজউদ্দিনের ভাই মফিজউদ্দিন এর সত্যতা স্বীকার করেন।

এদিকে জাইল্যা এলাকার রাইস মিলার নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি দাবি করেন, তাঁর বরাদ্দের ১১২ মেট্রিক টন চাল নিজের মিল থেকে দিয়েছেন। এ বিষয়ে ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ বলেন, ওই মিলের মালিক এসব চাল দিনাজপুরের অটোরাইস মিল থেকে কিনে গুদামে দিয়েছেন বলে তিনি স্বীকারও করেছেন। এখন তিনি মিথ্যা বলছেন। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে ধান সংগ্রহ না করে অন্য জেলা থেকে ট্রাকে রাতের আঁধারে নিম্নমানের চাল গুদামে মজুত করা হয়েছে। অথচ কাগজে-কলমে চুক্তিবদ্ধ মিলারদের নামে চাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মান পরীক্ষা করে প্রত্যয়নসহ খাদ্যগুদামে চাল সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান উপজেলার বাইরে থেকে অটোরাইস মিলের চাল কেনার বিষয়ে বলেন, ক্রয় কমিটির সভাপতি ইউএনও। কমিটির সদস্যদের নিয়ে সভা করে এবং রেজল্যুশনের মাধ্যমে ওই সব চাল গুদামে সরবরাহ করা হয়েছে। প্রত্যয়নপত্র ও চুক্তিপত্রের লাইসেন্স দেখে প্রকৃত মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল কেনা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।