জাতিসংঘ কমিটিতে উঠছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি

চলতি বছরের ১৪ মার্চের কথা। ঢাকার কেরানীগঞ্জের আটিবাজারের ২০ বছর বয়সী বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি শাহাদাত হোসেন ও তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে সেদিন সকালে কামারকান্দার তল্লাশিচৌকিতে পুলিশ থামতে বলে। তারপর পুলিশ কনস্টেবল সাইফুল কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি না দিয়েই শাহাদাতের ডান পায়ে গুলি করেন। আহত অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিকিৎসার সময়ও তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। তিন দিন পর দায়ের করা মামলায় শাহাদাতের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। শাহাদাতের প্রতি পুলিশের এই অমানবিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার ঘটনাটি আট বছর আগে ২০১১ সালে ঝালকাঠিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমন হোসেনের ওপর র‌্যাবের নিষ্ঠুর নির্যাতনের অনুরূপ।

১৯৯৮ সালে ঢাকার মালিবাগে পুলিশি নির্যাতনে নিহত শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর বিষয়ে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্ট ২০০৩ সালে গ্রেপ্তার এবং পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি নির্দেশনা জারি করেন। কিন্তু তার প্রায় দেড় যুগ পরও যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগ উঠছে, তার একটি প্রামাণ্য বিবরণ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে তুলে ধরেছে মানবাধিকার ফোরাম বাংলাদেশ। এতে নির্যাতনের শিকার অন্তত ৬৭ জনের দুর্ভোগের কথা উঠে এসেছে। তা ছাড়া, নির্যাতনের যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তা–ও বর্ণনা করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার দিন-তারিখ অনুসারে একটি তালিকাও এতে সংযুক্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, যাতে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৫টি কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের তথ্যও রয়েছে।

জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নির্যাতনবিরোধী কমিটির (কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার, ক্যাট) কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট মানবাধিকার ফোরাম এই রিপোর্ট পেশ করেছে।

জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া ক্যাটের ৬৭তম অধিবেশনে আজ এবং কাল বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে। সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর চার বছর পরপর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও ১৯৯৮ সালে সনদ অনুমোদনের পর গত ২১ বছরে বাংলাদেশ কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। ২৩ জুলাই সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো পেশ করা প্রতিবেদনে দেশে নির্যাতনবিরোধী যেসব আইন তৈরি করা হয়েছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান গঠন এবং প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিবরণ সরকারের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

ক্যাট ১০ জন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত, যে বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নির্বাচিত হন। এই কমিটির সভায় সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে বাংলাদেশ ২৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে, যার নেতৃত্ব দেবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং বিকল্প নেতা হলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিনিধিদলে জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, পররাষ্ট্রসচিব, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব, এনজিও ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, গোয়েন্দা সংস্থার দুজন কর্মকর্তা, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকও আছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে পাওয়া নির্যাতনের যেসব কৌশল বাংলাদেশে পুলিশি হেফাজত বা রিমান্ডে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলোর বিবরণও তুলে ধরেছে মানবাধিকার ফোরাম। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো, যা জেনারেল থেরাপি বা সা-রে-গা-মা নামে পরিচিত; হাত-পা বেঁধে দুই টেবিলের মাঝখানে শুইয়ে পায়ের তলায় পেটানো, ব্যাট থেরাপি বা বাদুড় ধোলাই; ছাদে ঝুলিয়ে নির্বিচারে পেটানো বা স্নেক থেরাপি; মাটিতে ফেলে মুখে ভেজা কাপড় ঢুকিয়ে নাক-মুখে পানি ঢালা বা ওয়াটার থেরাপি, যাতে ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে; পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁটতে বলা এবং ধাতুর তৈরি আংটিতে আঙুল ঢুকিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ইত্যাদি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও মহিলা পরিষদসহ ২১টি সংগঠন মানবাধিকার ফোরামের সদস্য। অবশ্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নির্যাতনবিরোধী কমিটির এই পর্যালোচনায় কোনো প্রতিবেদন পেশ করেনি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিশন তো সব অনুষ্ঠানে যায় না। আর মাঝখানে চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়েছেন। আগে যোগাযোগ কতটা হয়েছে, সে বিষয়ে ততটা অবহিত নই।’

বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে ওয়ার্ল্ড কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট ডেথ পেনাল্টি, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওডিআরআই ইন্টারন্যাশনাল রাইটস আলাদা আলাদা প্রতিবেদন পেশ করেছে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার, ওএমসিটি, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সসহ পাঁচটি সংগঠন বাংলাদেশের অপর একটি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সঙ্গে যৌথভাবে আরেকটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে ২৬টি বহুল আলোচিত ঘটনার বিবরণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের বিচারবহির্ভূত হত্যা। এই প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালেই নিহত হয়েছেন ৪৬৫ জন। একই সময়ে মোট ৫২৬ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে গুম হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার ও পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দিয়ে পুরস্কৃত করার কথা বলা হয়।

ওডিআরআই এবং ওয়ার্ল্ড কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট ডেথ পেনাল্টি বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ঘাটতির কথা বলেছে। জাতীয় আইনে নির্যাতনকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সনদের শর্তগুলো পুরোপুরি পূরণ করে না বলে উল্লেখ করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় আরও সুনির্দিষ্টকরণের আহ্বান জানিয়েছে।

সংগঠনটি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্যাতনের বিষয়টি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে এসব ঘটনায় অপরাধীর বিচারহীনতা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার কথা বলেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একজন মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি অথবা ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় অনেক অভিযোগ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।