মা নেই, বুঝতেই পারছে না ওরা

বর্ষা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
বর্ষা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

বর্ষা আক্তারের নিথর দেহ বাড়ির উঠানে। পাশেই স্বজনেরা আহাজারি করছিলেন। পাঁচ বছরের কন্যা আফরিন বারবার মায়ের নিথর দেহের কাছে ছুটে যাচ্ছে, আর মাকে ডাকছে। দেড় বছর বয়সী মেয়ে আরিন শুধু মা-মা বলে কান্না করছিল। স্বজনেরা তাকে কোলে করে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জব্বার আকনকান্দি গ্রামে আজ বুধবার সকালে বর্ষার বাড়ির দৃশ্য ছিল এটি। বর্ষা আক্তার (২৮) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। তিনি স্থানীয় শাহেদ আলী মাদবরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আজ দুপুরে তাঁর মরদেহ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বর্ষা আক্তার গত ১৮ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। জ্বর নিয়েই বিদ্যালয়ে যেতেন। বেশি অসুস্থ হয়ে পরলে গত ২৫ জুলাই পরিবারের সদস্যরা তাঁকে জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁর শরীরে ডেঙ্গুর আলামত পান। তারা তাঁকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ২৬ জুলাই বর্ষাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাঁকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। পরদিন ২৮ জুলাই তাঁকে ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকায় প্রএ্যাকটিভ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে বর্ষাকে কয়েক দফায় ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। তবে অবস্থা ক্রমশ অবনতি হয়ে গতকাল রাতে তিনি ওই হাসপাতালে মারা যান।

বর্ষার স্বামী মিজানুর রহমান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষার নিথর দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে এটা ভাবতে পারিনি। মেয়ে দুটি বারবার তাদের মায়ের খোঁজ করছে। আমি কী বলে তাদের সান্ত্বনা দেব? বড় মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গেই সারা দিন স্কুলে থাকত। সেখানে সে শিশু শ্রেণিতে পড়ত। আমি চাকরির কারণে ওদের থেকে দূরে থাকতাম। তাদের মা-ই ছিল সকল অভিমান আর বায়না করার জায়গা। আল্লাহ কেন আমার মাসুম সন্তানদের সে জায়গাটা কেরে নিল?’

জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষিকা জাজিরায় নিজ বাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। গত বৃহস্পতিবার আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঢাকায় স্থানান্তর করি। এখন পর্যন্ত জাজিরায় ছয়জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তারা সবাই ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গেছেন।’

স্বজনদের কোলে বর্ষা আক্তারের দুই শিশু কন্যা আফরিন ও আরিন। তারা ঠিক বুঝতে পারছে না তাদের মা আর নেই। জাজিরা, শরীয়তপুর, ৩১ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
স্বজনদের কোলে বর্ষা আক্তারের দুই শিশু কন্যা আফরিন ও আরিন। তারা ঠিক বুঝতে পারছে না তাদের মা আর নেই। জাজিরা, শরীয়তপুর, ৩১ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত শরীয়তপুর জেলায় ১০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু সচেতনতার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে। আমাদের উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। যারা এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।’

এর আগে বর্ষা আক্তার জাজিরার কলমিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্বামীর বাড়ি ছিল জাজিরার খেজুরতলা গ্রামে। ২০১৭ সালের পদ্মার ভাঙনে তাঁদের বসত বাড়ি ও বিদ্যালয় বিলীন হয়ে যায়। তখন পাশের জব্বর আকনকান্দি গ্রামে তাঁরা বাড়ি নির্মাণ করেন। ওই বাড়ির পাশের শাহেদ আলী মাদবরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন মাস আগে তিনি বদলি হন।

ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিলা আক্তার বলেন, ‘বর্ষার প্রাণ ছিল মেয়ে দুটি। আজ যখন ওর লাশ দেখতে যাই তখন মেয়ে দুটির দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মেয়ে দুটি বুঝতে পারছেও না তাদের মা সারা জীবনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন।’