জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির রেকর্ড

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাহিদা বেগম। স্ত্রীর পাশে বসে দুচিন্তায় দিন পার করছেন তাঁর স্বামী। গতকাল নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালের ওয়ার্ডে।  ছবি: দিনার মাহমুদ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাহিদা বেগম। স্ত্রীর পাশে বসে দুচিন্তায় দিন পার করছেন তাঁর স্বামী। গতকাল নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালের ওয়ার্ডে। ছবি: দিনার মাহমুদ

এবার শুধু জুলাই মাসেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ মাসে ১৪ হাজার ৯৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল ২০১৮ সালে। তখন পুরো বছরে ১০ হাজার ১৪৮ জন ভর্তি হয়েছিল। এই তথ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।

এডিস মশাবাহী এই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সাধারণত বছরের মে–জুন থেকে শুরু হয়। আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। কিন্তু এবার কেবল জুলাই মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল।

এবার ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে বেশি। সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রথম আলোর হিসাবে এ বছর মোট মৃত্যু হয়েছে ৬৩ জনের। এর মধ্যে সরকারের দেওয়া মৃত্যুর তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। শুধু সরকারি হিসাবে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা ১৪। গতকাল যাদের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে, তাদের মধ্যে ঢাকা ও বরিশালে ২ জন আছেন। এর মধ্যে একজন নারী পুলিশ সদস্য।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে এখন ডেঙ্গুর চারটি ভাইরাসেই (ডেনভি-১, ২, ৩ ও ৪) মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, এ বছর দ্বিতীয় দফায় আক্রান্ত হওয়া রোগী প্রায় ৫ শতাংশ। এদের ঝুঁকি বেশি।

এই পরিস্থিতিতে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, মশা নিয়ন্ত্রণ না হলে আগামী দুই মাসে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের মধ্যে। তাদের অনেকে চাচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি এগিয়ে এনে পরে তা সমন্বয় করতে। যদিও শিক্ষা প্রশাসন আগাম ছুটির বিপক্ষে। তাদের যুক্তি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক নিরাপদ। আর ছুটি দিলে বাড়িতেও যে বাচ্চারা আশঙ্কামুক্ত থাকবে, তা–ও নিশ্চিত নয়।

তিনজনের মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম বলছে, গতকাল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৪ হাজার ৯০৩ রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া ১ হাজার ৪৭৭ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যা এ বছর এক দিনে ভর্তি হওয়া রোগীর দিক থেকে সর্বোচ্চ। গত মঙ্গলবার ভর্তি ছিল ১ হাজার ৩৩৫ জন।

>ডেঙ্গু পরিস্থিতি
এক মাসেই ১৪,৯৯৬ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি
আরও তিনজনের মৃত্যু
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভয়, আগাম ছুটি হচ্ছে না

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর মাত্র ৩৫টি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য প্রকাশ করছে। কিন্তু ঢাকা শহরের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এখন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এ রকম প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সাড়ে তিন শ। তাই সব হাসপাতালের তথ্য সরকারের কাছে নেই।

গত মঙ্গলবার পুলিশের বিশেষ শাখার উপপরিদর্শক (এসআই) কোহিনুর আক্তার ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন। কোহিনুরের স্বামী শেখ জহির রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, গত শুক্রবার সকাল থেকে তাঁর স্ত্রীর জ্বর ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গত রোববার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে কোহিনুরকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র না থাকায় কোহিনুরকে লালমাটিয়ায় সিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

গত মঙ্গলবার রাতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের বাসিন্দা আলেয়া বেগম (৫০) মারা গেছেন। গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মীর্জা মাহবুব বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আলেয়া মারা যান। স্বজনেরা জানান, আলেয়া বেগম ঢাকায় থাকার সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জব্বার আকনকান্দির বর্ষা আক্তার (২৮) নামের এক শিক্ষক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি স্থানীয় শাহেদ আলী মাদবরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

রি–এজেন্ট সংকট
রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণে এনএস১ পরীক্ষার রি–এজেন্ট সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। রি–এজেন্ট কিনতে কোথাও কোথাও দাম বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ জুলাই থেকে প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন অভিভাবক গতকাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে ঈদের ছুটি এগিয়ে আনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

.
.

এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ৮ আগস্ট থেকে ঈদের ছুটি শুরু হবে। কয়েকজন অভিভাবক ছুটি এগিয়ে আনার দাবি করেছেন। বিষয়টি সভাপতিকে জানিয়েছেন। ছাত্রীদের উপস্থিতি আগের চেয়ে ‘হালকা কম’ বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ ছুটি এগিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করলেও শেষ পর্যন্ত সেটি করেনি। এখন আগের ঘোষণা অনুযায়ী ৭ আগস্ট থেকে ছুটি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও অনেকে ছুটির দাবি জানিয়েছেন। এই দাবিতে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পুরো বিষয়টি তাঁরা পর্যালোচনা করেছেন। এ মুহূর্তে অগ্রিম ছুটি দিতে চান না। কারণ ছুটি দিলেই যে বাচ্চারা আশঙ্কামুক্ত থাকবে, তা–ও নয়; বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হচ্ছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক নিরাপদ। আর এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও স্কাউটদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। অনেকে বাড়ি বাড়ি গিয়েও কাজ করছেন।

এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চার দফা নির্দেশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খেলার মাঠ ও ভবনগুলো পরিষ্কার রাখা, মাঠ বা ভবনে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলা, ফুলের টব নিয়মিত পরিষ্কার করা এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা।