জামালপুরে মাছের সঙ্গে স্বপ্নও গেল

.
.

হারুন অর রশিদ পেশায় মৎস্য খামারি। তিল তিল করে গড়ে তোলা মৎস্য খামারটি নিয়ে ছিল তাঁর নানা স্বপ্ন। খামারের আয় দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। শুধু তাঁর নয়, খামারে কর্মসংস্থান হওয়া ২০ জন নারী-পুরুষের সংসারও ভালোই চলছিল। কিন্তু কে জানত পানির সঙ্গে ভেসে যাবে তাঁর সব স্বপ্ন।

বহু কষ্টে গড়ে তোলা খামারটি পানির স্রোতে তছনছ হয়ে গেছে। পানির সঙ্গে ভেসে গেছে হারুন অর রশিদের ২০টি পুকুরের প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ। তিনি এখন সর্বস্বান্ত।

জামালপুর সদর উপজেলার তিতপল্লা এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ। তাঁর মতো সারা জেলায় বানের পানিতে ভেসে গেছে ৬ হাজার ৭৯৬ জন মৎস্য খামারির স্বপ্ন।

হারুন অর রশিদ বলেন, কল্পনার মধ্যেও ছিল না, এত দূরের বন্যা এই এলাকায় আসবে। নিজের পরিশ্রমের ঘামে খামারটি গড়ে তুলেছেন। রাত-দিন খামার নিয়েই থেকেছেন। খামারে বিশাল আকারে ২০টি পুকুর ছিল। বড় বড় মাছ ছিল সেসব পুকুরে। ২০টি পুকুরে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ ছিল। কিছুদিন পরেই পুকুরের মাছ বিক্রি করতেন। কিন্তু কে জানত তাঁর এমন সর্বনাশ হবে। এক রাতের মধ্যে বন্যার পানিতে সব পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। মাছের জন্য প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার খাবার ছিল। সেটাও পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাঁর।

হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। পুকুরে এখন কোনো মাছ নেই। একদম পথে বসে গেছি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। আমরা এখন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব। আমাদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, সারা জেলায় ৬ হাজার ৭৯৬টি খামার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এসব খামারের ৯ হাজার ৩২টি পুকুর বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এতে ২ হাজার ৯৮৪ দশমিক ৩২ মেট্রিক টন মাছ ও ২৫৯ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন পোনা মাছ ভেসে গেছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি ৭ কোটি ১৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার। সব মিলে ৪৭ কোটি ৯৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

হারুন অর রশিদের মতো জামালপুর সদর উপজেলার চরশি মুন্সিপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ পলাশ মিয়ারও একই অবস্থা। বন্যার পানিতে তাঁর ছয়টি পুকুর ভেসে গেছে। পানির সঙ্গে তাঁর প্রায় ৩৫ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে। তিনিও এই খামারের ওপর নির্ভরশীল। মাছ চলে যাওয়ায় তিনি অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বলেন, ‘এত বড় ক্ষতি। একদম পথে বসে গিয়েছি। এই খামার থেকেই পুরো পরিবার চলত। কোনো পুকুরে মাছ নাই। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব বুঝতে পারছি না।’

একই অবস্থা ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী এলাকার দেলুয়ার হোসেন, পূর্ব বাবনা গ্রামের আক্তারুজ্জামান, দেলিরপাড়া এলাকার আবু বক্কর, চিনাডুলী এলাকার আবদুস ছালাম ও পশ্চিম বামনা এলাকার লানঞ্জু মিয়া ও আবদুল খালেকের। তাঁদের সবার খামারের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। দেলুয়ার হোসেন বলেন, ‘নদীভাঙন এলাকার মানুষ। মৎস্য খামার দিয়ে কোনো রকম সংসার চালাই। পুরো খামারে আমার পরিবার শ্রম দিত। পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ার সময় অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পানির স্রোত এতটা ছিল যে কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। সব মাছ ভেসে গেছে। এখন রাস্তার ফকির।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ বলেন, বন্যায় মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খামারিরা এখন অনেকটাই পথে বসার মতো। প্রতিটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সারা জেলার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বন্যায় সব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও মৎস্য খামারিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। এবারের বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণ না দেওয়া গেলে তাঁরা মাছ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।