জরিপের নামে কোটি টাকা ঘুষ?

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় দিয়ারা জরিপের নামে জমির মালিকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জরিপকর্মীদের বিরুদ্ধে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিয়ারা জরিপের নামে উপজেলার চর সিঙ্গাইর, রিফায়েতপুর, দক্ষিণ জামশা, বায়রা ও বিনোদপুর ছোট খণ্ড মৌজায় জমির মালিকদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে খতিয়ানপ্রতি এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেছেন উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিস ও দিয়ারা অপারেশন নরসিংদী উপ-আঞ্চলিক (ক্যাম্প) কার্যালয়ের জরিপকর্মীরা। জমির পরিমাণ, দাগ খতিয়ান ঠিক রাখতে ও ভুলত্রুটি সংশোধন করতে জরিপকর্মীদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন জমির মালিকেরা। এ নিয়ে অধিকাংশ জমির মালিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে উপজেলার রিফায়েতপুর, দক্ষিণ জামশা, বায়রা ও বিনোদপুর ছোট খণ্ড মৌজা এবং জুন মাস থেকে উপজেলার চর সিঙ্গাইর মৌজায় দিয়ারা ভূমি জরিপের কাজ শুরু হয়। চর সিঙ্গাইর মৌজায় দিয়ারা জরিপ করে নরসিংদী উপ-আঞ্চলিক (ক্যাম্প) কার্যালয়। বাকি চারটি মৌজায় উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসের জরিপ দলের সদস্যরা জমি জরিপ করেন। চর সিঙ্গাইর মৌজাকে ৯টি, রিফায়েতপুর মৌজাকে ৯টি, দক্ষিণ জামশা মৌজাকে ৮টি, বায়রা মৌজাকে ১০টি এবং বিনোদপুর ছোট খণ্ড মৌজাকে ৩টি সিটে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সিটে একজন সার্ভেয়ারের (জরিপকারী) নেতৃত্বে একজন সর্দার আমিন, একজন বদর আমিন, একজন চেইনম্যানসহ ৫টি মৌজায় মোট ১৫৬ জন জরিপকর্মী জমি জরিপকাজে নিয়োজিত রয়েছেন। জরিপকাজ তদারক করছেন দিয়ারা অপারেশন নরসিংদী উপ-আঞ্চলিক ক্যাম্পের রাজস্ব কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু তাহের ও সিঙ্গাইর উপজেলা সহাকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস।

গত বুধবার দুপুরে কাংশা গ্রামে দিয়ারা জরিপের অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে উপজেলার গোলড়া গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসানকে পরচার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে কার্যালয়টি তালাবদ্ধ থাকায় তাঁর মতো আরও বেশ কয়েকজন জমির মালিক এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরে যান।

এ সময় কথা হলে মাহমুদুল হাসান বলেন, পৈতৃক ১০ শতক জমি তিন ভাইয়ের নামে রেকর্ড করতে চর সিঙ্গাইর মৌজার দায়িত্বপ্রাপ্ত জরিপকারী শফিকুর রহমান তাঁর কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। দর-কষাকষির পর দুই হাজার টাকায় এই জমি রেকর্ড করা হয়।

 সদর ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামের কৃষক আওলাদ হোসেন অভিযোগ করেন, ১৪ শতক জমির জরিপকাজের জন্য চার হাজার টাকা দাবি করেন জরিপকারী হারুন অর-রশিদ। পরে বাধ্য হয়ে দুই হাজার টাকা দিলে জমি রেকর্ডভুক্ত করা হয়।

বুধবার চরে গিয়ে কথা হয় সিঙ্গাইর পৌরসভার চর সিঙ্গাইর গ্রামের বাড়িতে ফজলু খানের সঙ্গে। তাঁর বাবা ও দুই চাচার নামে ১৯ শতক জমি রয়েছে। দখল ও মালিকানাসংক্রান্ত সব কাগজপত্র সঠিক থাকলেও জমি রেকর্ডভুক্ত করার জন্য তিন হাজার টাকা দাবি করেন জরিপকারী শফিকুর রহমান। পরে দুই হাজার টাকা দেওয়ার পর জমির জরিপকাজ সম্পন্ন হলেও জমির পরচা দেওয়া হয়নি।

একই গ্রামের শাহিন খান অভিযোগ করেন, চর সিঙ্গাইর গ্রামে তাঁর দাদার ২২ শতক জমি ভুলক্রমে আহাদ খোন্দকার নামের এক ব্যক্তির নামে আরএস রেকর্ড হয়। ওই জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন শফিকুর রহমান। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় রেকর্ড সংশোধন করা হয়নি।

বুধবার অন্তত ২০ জন জমির মালিকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, জমি রেকর্ডভুক্ত করতে তাঁদের প্রত্যেককেই টাকা দিতে হয়েছে। তাঁরা জানান, প্রতি খতিয়ানে এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন জরিপকর্মীরা। তাঁদের দাবি, উপজেলার ৫টি মৌজায় দিয়ারা জরিপের নামে জমির মালিকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জরিপ দলের লোকজন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জরিপকারী শফিকুর রহমান ও হারুন অর-রশিদ। তাঁরা বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। জমি রেকর্ডভুক্ত করতে কোনো টাকাপয়সা নেওয়া হয় না। কাজ করার পর কেউ খুশি হয়ে দিলে সেটা নিলে তো দোষের কিছু নয়।

এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস বলেন, জমির জরিপ করছে দিয়ারা জরিপ বিভাগ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ওই বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে দিয়ারা অপারেশন নরসিংদী উপ-আঞ্চলিক কার্যালয়ের রাজস্ব কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু তাহের বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট জরিপকর্মীদের বিরুদ্ধে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহেলা রহমত উল্লাহ বলেন, দিয়ারা জরিপকাজের জন্য টাকাপয়সা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। জরিপকারী দলের লোকজনের বিরুদ্ধে জমির মালিকদের কাছ থেকে অভিযোগের ভিত্তিতে আগামীকাল শনিবার উপজেলা পরিষদে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এতে জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস এবং জমির মালিকেরা ও জরিপকারী দলের লোকজন উপস্থিত থাকবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (শেষ)