ফেনী কারাগারে ঢুকে দুই যুবলীগ নেতাকে হুমকি

ফেনী কারাগারের কনডেম সেলের ৩ নম্বর কক্ষে ঢুকে যুবলীগের দুই নেতাকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ চারজনের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন ওই দুই হাজতি। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

অভিযোগকারী দুজন হলেন ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এম আজহারুল হক ওরফে আরজু এবং ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া। তাঁরা পৃথক চিঠিতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার, আওয়ামী লীগের কর্মী সাহাব উদ্দিন, এস আলম সবুজ ও ফেনী সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

গত ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিবের (সেবা সুরক্ষা বিভাগ) কাছেও অভিযোগ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়ার আট দিন পর ১৭ জুলাই ফেনী পৌরসভার মধুপুরে শাখাওয়াত হোসেনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। তিনি এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই শাখাওয়াত নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্য পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের জুনে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। অস্ত্র মামলায় সাজা কম খেটে নিজাম হাজারী কারাগার থেকে বেরিয়ে যান বলে এ-সংক্রান্ত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে রিটটি করেছিলেন তিনি।

অভিযোগকারী আজহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিদের রাখা হয়। অথচ গ্রেপ্তারের পর তাঁদের সেখানে রাখা হয়েছিল। তাঁর দাবি, ওই হুমকি-ধমকির সঙ্গে শাখাওয়াতের ওপর হামলার যোগসূত্র রয়েছে।

 মন্ত্রী-সচিবের কাছে অভিযোগ

আজহারুল ও শাখাওয়াত লিখিত অভিযোগে জানান, গত ৩১ মার্চ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত শাখাওয়াত এবং ১ এপ্রিল থেকে ২৭ মে পর্যন্ত আজহারুল হক ফেনী কারাগারের কনডেম সেলের ৩ নম্বর কক্ষে বন্দী ছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল বেলা আনুমানিক সাড়ে তিনটায় সেই সেলে প্রবেশ করেন ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার ও সাহাব উদ্দিন। তাঁরা আজহারুল ও শাখাওয়াতের কাছে জানতে চান, ‘তোদের কয়টি মামলা আছে? তোরা কোনো মামলায় জামিন করাবি না। জামিন করালে জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর তোদের একরাম চেয়ারম্যানের মতো পুড়িয়ে হত্যা করা হবে।’

এরপর ৫ জুন দুপুর ১২টায় এস আলম সবুজ এবং ফেনী সদর থানার এসআই নজরুল ইসলাম কনডেম সেলের ৩ নম্বর কক্ষে ঢুকে শাখাওয়াতকে হুমকি দিয়ে বলেন, কারাগার থেকে বের হয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হবে। 

তবে এসআই নজরুল কারাগারে প্রবেশের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘শাখাওয়াতের একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমি। আমাকে ফাঁসাতে তিনি এই অভিযোগ দিয়েছেন।’

আজহারুল হকের বিরুদ্ধে ফেনীতে ইউপি ভবনে ভাঙচুর, গ্রামে দোকান লুটপাটসহ আটটি এবং শাখাওয়াতের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে নাশকতা সৃষ্টি ও ডাকাতিসহ চারটি মামলা হয়। নাশকতার মামলায় শাখাওয়াতের সঙ্গে অন্য সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে। আজহারুলের অভিযোগ, স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁদের এসব মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যা বলছেন

ইউপি চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। ১৩ এপ্রিল আজহারুল হকের সঙ্গে কারাগারে দেখা করার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যস্থতা করতে আমাদের এমপির (নিজাম হাজারী) সঙ্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেলের ভেতরে প্রবেশ করার অভিযোগ সত্য নয়। তবে আরজুর (আজহারুল হক) সঙ্গে কথা বলার সময় দূর থেকে শাখাওয়াত আমাকে গালিগালাজ করেছে।’

মধ্যস্থতার বিষয়টি ঠিক নয় বলে দাবি করে আজহারুল বলেন, ১৩ এপ্রিল কারা সেলে ঢুকে তাঁকে হুমকি দেন হারুন মজুমদার। এস আলম সবুজও কারাগারে ঢুকে কাউকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সাংসদ নিজাম হাজারী দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাংসদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও ফেনী সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শহীদ খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজহারুল হক ও শাখাওয়াতকে কারাগারের ভেতরে হুমকি প্রদর্শনের অভিযোগ সত্য নয়, বরং তাঁরা জেলারকে গালিগালাজ করতেন বলে বাইরে প্রচার আছে। এ জন্য কারাগারে তাঁদের নজরদারিতে রাখা হতো বলে শুনেছি। কিন্তু এমপি সাহেবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।’

কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

ফেনী কারাগারের জ্যেষ্ঠ সুপার মো. রফিকুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, কারা অভ্যন্তরে বহিরাগত লোকজনের প্রবেশের সুযোগ নেই। সেলের ভেতরে হাজতি আজহারুল হক ও শাখাওয়াতকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, ‘দুটি ভিন্ন তারিখে (৫ জুন ও ১৩ এপ্রিল) দুজনকে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জুন স্থানীয় সাংসদ, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, দুজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনের সঙ্গে আমি কারাগারের ভেতরে বৈঠকে ব্যস্ত ছিলাম। আর ১৩ এপ্রিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। ওই দিন চুল কাটাতে কারাগার থেকে একটু দূরে শহরের একটি সেলুনে ছিলাম। কথিত ঘটনার সময় এমপি সাহেব কারাগারে যান। তিনি নারী সেল পরিদর্শন করে ফিরে যান।’

একজন সাংসদ চাইলেই কারা অভ্যন্তরে যেতে পারেন কি না, জানতে চাইলে কারা কর্তৃপক্ষের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সাংসদেরা কারাগারে ঢুকতে পারেন। একটি জেলায় একাধিক সাংসদ বলে তাঁরা দুই মাসে একবার করে পর্যায়ক্রমে ঢুকতে পারেন।

এ বিষয়ে কথা হয় কারা মহাপরিদর্শক এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশার সঙ্গে। তিনি বলেন, কারাগারে ঢুকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি চলতি সপ্তাহে ফেনীর জেল সুপারকে ডেকেছে। তদন্ত শেষ করার পরই প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।