মশা মারার গলদ গোড়াতেই

মশকনিধন কার্যক্রমে এসে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। গতকাল পূর্ব বাসাবোর ওয়াসা রোডে।   ছবি: প্রথম আলো
মশকনিধন কার্যক্রমে এসে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। গতকাল পূর্ব বাসাবোর ওয়াসা রোডে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশা মারার ওষুধ ছিটানোর কর্মীদের অবস্থা যেন ছোটবেলায় পড়া ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ কবিতার মতোই। হারাধনের ছেলেরা পাড়াময় ঘুরে বেড়ায় আর একজন একজন করে হারিয়ে যায়। গতকাল শুক্রবার সকালে ডিএসসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ ও পূর্ব গোড়ানে মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানোর কথা ছিল ছয়জনের। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল, কাজ করছেন তিনজন।

বাকিরা তাহলে কোথায় হারালেন? মশার লার্ভা ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত স্প্রেম্যান দলটির প্রধান মো. খলিলুর রহমান বললেন, ছয়জনের মধ্যে একজন হজ করতে গেছেন। আরেকজন সপ্তাহখানেকের জন্য অন্য ওয়ার্ডে কাজ করছেন। দলের একমাত্র নারী সদস্য বাসাবাড়িতে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল আছে কি না, তা জরিপের কাজে যুক্ত।

স্থানীয় কাউন্সিলর আনিসুর রহমানের দক্ষিণ গোড়ানের বাসার নিচতলা থেকে গতকাল সকাল ৮টা ২৪ মিনিটে ছয়জনের দলটির তিনজন মশার লার্ভা মারার যন্ত্র (হ্যান্ড মেশিন) নিয়ে বের হন। রাস্তায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তিনজন তিন দিকে চলে যান। তাঁদের একজনের সঙ্গে ছিলেন এই প্রতিবেদক। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ওষুধ ছিটানোর কাজটি শেষ করতে হয়। যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে এই ওষুধ ছিটানোর কথা। কিন্তু স্প্রেম্যানকে দেখে লোকজন তাঁদের দোকান–বাসাবাড়ির পাশেও ওষুধ ছিটাতে বলেন। তিনিও কাউকে নিরাশ করেননি।

দক্ষিণ গোড়ান এলাকায় সিটি করপোরেশনের এই স্প্রেম্যান যখন ওষুধ ছিটাচ্ছিলেন, তখন সড়কের পাশে থাকা দোকানিরা তাঁকে দেখে বলেন, ‘ভাই, মশা তো মরে না।’

২ নম্বর ওয়ার্ডের পাশের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গতকাল সকালে মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানোর কথা ছিল ছয়জনের। কিন্তু ওষুধ ছিটাতে এসেছিলেন তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজন আবার যন্ত্র ছাড়াই এসেছেন। তিনিই আবার তাঁদের দলনেতা। সকাল সোয়া নয়টায় পূর্ব বাসাবোর ওয়াসা রোডে ওষুধ ছিটানোর কথা ছিল দলটির।

>


ডিএসসিসির চারটি ওয়ার্ড
সকালে মশার লার্ভা ধ্বংসের ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের
অর্ধেকই মাঠে থাকেন না

দলনেতা হযরত আলী বলেন, একজন স্প্রেম্যান ৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করছেন। আরেকজনের মশা মারার যন্ত্র নষ্ট। তাহলে আরেকজন কোথায়? এর জবাবে দলনেতা বললেন, শিগগিরই চলে আসবেন। প্রায় ২০ মিনিট পর তৃতীয় স্প্রেম্যান ওয়াসা রোডে এসে উপস্থিত হন। তিনি এসে দলনেতা হযরত আলীকে জানান, তাঁর কাছে থাকা মশার লার্ভা ধ্বংস করার যন্ত্রটিও নষ্ট। সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করার কথা থাকলেও ১০টা পর্যন্ত তাঁরা ওষুধ ছিটাতে বের হননি। কারণ কী, জানতে চাইলে হজরত আলী বলেন, সিটি করপোরেশেন স্বাস্থ্য বিভাগের বড় কর্মকর্তা আসবেন। তাই তাঁদের অপেক্ষা  করতে বলা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস কয়েকজন নেতা–কর্মীসহ হাজির হন। তখন তাঁকে ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নেতা–কর্মীরা। চলে ফটোসেশন। স্প্রেম্যানদের সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করার বিষয়টি ফেসবুক লাইভে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের এক কর্মী। প্রায় ২০ মিনিট চলে ফেসবুক লাইভ। নেতারা এলাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বক্তব্য দেন। সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

পূর্ব বাসাবোর ওয়াসা রোডের পরই ৬ নম্বর ওয়ার্ড শুরু। এই ওয়ার্ডে মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য গতকাল ছয়জন স্প্রেম্যানের কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ করেছেন মাত্র দুজন।

দলনেতা আবদুস সালাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বাকি স্প্রেম্যানদের মধ্যে একজন নারী। তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আরেকজন
কাজ করছেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। আর তিনি ও তাঁর আরেক সহযোগী কাজ তদারক করছেন। যে কারণে তাঁরা ওষুধ ছিটাচ্ছেন না। তবে যে দুজন ওষুধ ছিটাচ্ছিলেন (দক্ষিণ মুগদাপাড়া) তাঁদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম। এই কাউন্সিলর বলেন, গত এক সপ্তাহে বাসাবাড়ির মালিকেরা নিজ উদ্যোগে আবর্জনা পরিষ্কার করছেন, সচেতনতা বেড়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্প্রেম্যানদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সুস্থ থেকেও কেউ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাঁকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।

বিকেলের চিত্র

উড়ন্ত মশা মারার কাজটি হয় বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে এই কাজ করার কথা ১০ জনের, কিন্তু করেছেন মাত্র দুজন। গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে এই ওয়ার্ডের সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের পোশাক পরা দুজন কর্মী দুটি ফগার মেশিন (উড়ন্ত মশা মারার যন্ত্র) নিয়ে বসে আছেন। ওয়ার্ডের স্প্রেম্যানদের দলনেতা কহিনুর ইসলামও তাঁদের সঙ্গে আছেন। তবে তাঁর হাতে মেশিন নেই। করপোরেশনের দেওয়া পোশাক পরেননি তিনি।

দলের বাকি সদস্যরা কোথায়, জানতে চাইলে কহিনুর ইসলাম বলেন, একজন মিন্টো রোডে ফগিং করছেন। শুক্রবার হওয়ায় অন্যরা আসেনি। কোন এলাকায় মশা মারার ওষুধ ছিটাবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে এলাকায় ফগিংয়ে (ধোঁয়া ওড়ালে) আপনার ছবি ভালো আসবে, সেখানেই ফগিং করা হবে।’