ঢাকার বাইরেও এডিস মশা

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলেটি। মা মশারির ভেতর তাকে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। সদর আধুনিক হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি, ৩ আগস্ট। ছবি: নীরব চৌধুরী
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলেটি। মা মশারির ভেতর তাকে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। সদর আধুনিক হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি, ৩ আগস্ট। ছবি: নীরব চৌধুরী

ঢাকা ছাড়াও দেশের অনেক শহরে এডিস মশা আছে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি শহরেও এডিস মশা পাওয়া গেছে। একাধিক গবেষকের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, এসব শহরে মশানিধন কার্যক্রম জোরদার না করলে সব জায়গায় পরিস্থিতির অবনতি হবে।

সরকার বলছে, ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে অন্তত ২৬টি জেলার আড়াই শতাধিক রোগী স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ এসব জেলায় এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়েছে।

এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত মোট ২১ হাজার ২৩৫ জন রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৬ হাজার ৫৮২ রোগী ভর্তি ছিল। ঢাকা শহর বাদে গতকাল দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১ হাজার ৯৬৯ জন। দেশের কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই হিসাব দিচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর নিজস্ব সংকলন অনুযায়ী, এবার ডেঙ্গুতে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক নারীর মৃত্যু হয়। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে গত বুধবার মারা গেছে একটি শিশু। আর ঢাকার বাইরে নোয়াখালী শহরের প্রাইম হাসপাতালে মোশাররফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার হুগলিতে। জেলার সিভিল সার্জন মো. মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মোশাররফ কুমিল্লায় জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

ঢাকার বাইরে এডিস মশার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কবিরুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় সব বড় শহরে এডিস মশা আছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে জরিপে এটা দেখেছি।’ এই গবেষকের পিএইচডির বিষয় ছিল মশা।

এডিস মশার দুটি প্রজাতি—এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপটাইয়ের মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। কম হলেও এডিস অ্যালবোপিকটাসও ডেঙ্গু ছড়ায়। গ্রামাঞ্চলে এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি। এডিস ইজিপটাই বেশি শহর এলাকায়।

>

ঢাকার বাইরে অন্তত ২৬ জেলায় আড়াই শতাধিক মানুষ স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত
ঈদের সময় ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি

নৌ, সড়ক, রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির হিসাবে, ঈদের সময় ঢাকা-গাজীপুর-নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের বড় অংশ যাবে ঢাকা থেকে। এদের অনেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই এডিস মশা বেশি আছে, এমন অঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ছড়ানোর ঝুঁকি ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি।

কোথায় এডিস মশা

কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মশার ওপর জাতীয় কোনো জরিপ হয়নি ঠিকই, তবে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেশের বড় কিছু শহরে এডিস ইজিপটাই পেয়েছি। এর মধ্যে আছে খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি। আমরা সীতাকুণ্ডেও এডিস মশা পেয়েছি।’ এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এডিস মশা সারা দেশে থাকবে, ছড়িয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা সময়ে মশার জরিপ করেছে। ২০০০-২০০৪ সালের মধ্যে তারা ১২টি শহরে জরিপ করেছিল। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে এডিস মশা পেয়েছিল। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা গত বছরও এই জরিপ করেছিল। তখনো ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে এই মশা পেয়েছিল।

অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেন, সব বড় শহরেই এডিস মশা থাকার উপযুক্ত পরিবেশ আছে। তবে এ বছর তাঁরা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এই মশা পেয়েছেন। গত বছর পেয়েছিলেন রাজশাহী শহরে।

২৬ জেলায় সংক্রমণ

গতকাল সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, মশা শনাক্ত করার যন্ত্রপাতি ও জনবল তাঁদের আছে। তাঁরা সিরাজগঞ্জ শহরে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন। এ ছাড়া সিলেট ও রাঙামাটিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে জেলা দুটির সিভিল সার্জন কার্যালয়।

২৬টি জেলার সিভিল সার্জন, আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনেরা জানিয়েছেন, এসব জেলার আড়াই শতাধিক রোগী স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

আবার ঢাকা থেকে অনেকে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে যাচ্ছে। আবার বাসে, ট্রেনে, লঞ্চেও এডিস মশা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাচ্ছে। তবে সারা দেশের পরিস্থিতি কী, তা পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারছেন না।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উপদেষ্টা অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের মশা পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের কাছে পরিষ্কার চিত্র থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সহায়তা নিতে পারে। এখনই অন্যান্য শহরে মশানিধনে নেমে পড়তে হবে।

ঈদে মানুষ ঢাকা ছাড়বেই। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষকে ঢাকা শহর না ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, দীর্ঘ পথযাত্রা ডেঙ্গু রোগীর জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। আর ঢাকার বাইরে রোগীর পরিস্থিতি হঠাৎ খারাপ হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা না-ও হতে পারে।

ঢাকার বাইরে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক ও গবেষকেরা। তাঁরা বলেছেন, এডিস মশা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস, ট্রেন ও লঞ্চ মশামুক্ত রাখতে হবে।