গরুর পাল ও রাখাল দলের গল্প

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাবুডাইং বনের পাশে চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল।  ছবি: প্রথম আলো
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাবুডাইং বনের পাশে চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। ছবি: প্রথম আলো

কখনো পদ্মার ধু ধু চর ও কখনো বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র ভূমিতে বছরে আট-নয় মাস অসংখ্য গরু-বাছুরের পাল দেখা যায়। একেক পালে থাকে কমবেশি ২০০ থেকে ৫০০ গরু-বাছুর। সঙ্গে থাকে তিন থেকে সাতজনের রাখালের দল। কিছু বড় পালে রাখালের সংখ্যা ১০। গরুর সংখ্যার সঙ্গে রাখালের সংখ্যা ওঠা-নামা করে। এই রাখালের দলগুলো বেদুইনদের মতো। কদিন এখানে তো কদিন সেখানে বাঁধে আস্তানা। পলিথিন বা ত্রিপলের তাঁবু দিয়ে গড়া হয় এসব আস্তানা। কখনোবা ছাতার তলে কাটে রাত। গরুগুলো থাকে খোলা আকাশের নিচে। একসঙ্গে গরু চরান তাঁরা। 

গরুর পাল আর রাখালদের এ জীবনে যেমন মজা রয়েছে, তেমনি রয়েছে কষ্টও। সম্প্রতি একদিন সকালে শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বরেন্দ্র এলাকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউপির সীমান্তঘেঁষা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দোয়াতপোখরায় রাখালদের এক আস্তানায় গিয়ে দেখা গেছে, দুধ সংগ্রহের স্থানে বাছুরগুলোকে জড়ো করা হয়েছে। একটু দূরেই রয়েছে গাভিগুলো। এরপর রাখালেরা নাম ধরে ডাকা শুরু করলেন। চলচ্চিত্রের নায়িকাদের নাম বেশি উচ্চারিত হতে শোনা গেল। রাখালদের কণ্ঠে ‘শাবানা, শাবানা, শাবানা-আ-আ’ ‘ববিতা, ববিতা-আ-আ’ উচ্চারিত হওয়ার পর দেখা গেল, বসে থাকা দুধেল গাভিগুলো দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিচ্ছে। এরপর এগিয়ে গেল আমন্ত্রণকারী রাখালের কাছে। সেখানে থাকা বাছুরের পিঠে এক মুঠ লবণ দিলেন রাখাল। সেই লবণ চেটে খাওয়া শুরু করল গাভি। আর গাভির দুধ খেতে শুরু করল বাছুর। কিন্তু সুযোগ পেল খুব সামান্যই। রাখাল বাছুরটিকে সরিয়ে বেঁধে রাখলেন গাভির সামনের এক পায়ের সঙ্গে।

রাখালেরা জানান, প্রতিটি পালের প্রতিটি গরুর আলাদা নাম রয়েছে। জন্ম নেওয়ার পর মানবশিশুর মতোই নাম রাখা হয় প্রতিটি বাছুরেরও। আর পালের রাখালেরা প্রতিটি গরুর নাম জানেন। গরুর পালের রাখাল রুহুল আমিন এইচএসসি পাস। আট বছর থেকে এই পেশায় জড়িত। পাঁচটি গরু নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন। এখন ৪০টি গরুর মালিক। তাঁর বাবা–দাদাও ছিলেন রাখাল। এই রাখাল দলের সবচেয়ে কম বয়সী ব্যক্তি আসাদুল (১৬)। আট বছর বয়সে নিজের দুটি গরু নিয়ে রাখাল দলে যোগ দেয়। এখন আছে ১৬টা। আসাদুল বলে, ‘হামার অন্য বন্ধুরা যখন স্কুলে যাইতোক, হামি তখুন গরু লিয়া মাঠে মাঠে। পোরথম পোরথম খারাপ লাগতোক। এখন আর লাগে না। হামার গরুগালার দাম হোইবে পাঁচ-সাত লাখ টাকা। হামারঘে মতন গরিবেরঘে এটাই ম্যালা।’

এ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাখাল মো. মর্তুজা (৭০)। প্রায় ছয় দশকের অভিজ্ঞতা। তাঁকে সবাই নেতা মানেন। তবে তাঁকে নিয়ে হাসি-তামাশাও করতে দেখা যায় সবাইকে। মোর্তুজা বলেন, ‘হামরা নিজেরঘে ভিতরে হাসি-ঠাট্টা কর্য্যাই চলি। মনে খানিক আমোদ না থাকলে কি এমুন খাটনির কাম করা যায়? বাড়িঘর থুয়্যা, বহুবিটি ছাইড়্যা থাকা যায়?’

যেখানে রাখালেরা ডেরা বাঁধেন, সেখানে তাঁরা গোবরের স্তূপ তৈরি করেন। সারের জন্য তাঁদের এসব গোবরের স্তূপ কিনে নেন কৃষকেরা। তবে কেনা হয় চালের বিনিময়ে। আশপাশের কৃষকেরা সার পেতে রাখালদের চাল দেন। তাই মাঠে থাকার সময় রাখালদের চাল কিনে খেতে হয় না। তরিতরকারি বা মাছ-মাংসের ঘাটতি তাঁরা পূরণ করেন নিয়মিত দুধ পানে। এই রাখাল দলের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর ও কালুপুর গ্রামে।

রাখালেরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ঝিলিম ইউপি ও পাশের রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর ইউপির চার-পাঁচ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে কমপক্ষে ২০টি গরুর পাল বোরো ধান কাটার পর থেকে আস্তানা গেড়েছিল। এই বর্ষায় আমন ধান আবাদ শুরু হওয়ায় একে একে পালগুলো বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। চৈত্র মাসে চৈতালি ফসল কাটার তাঁরা গরুর পাল নিয়ে মাঠে নেমে ছিল। আমন ধান কাটার পর আবারও বরেন্দ্রর মাঠে মাঠে দেখা যাবে বহু গরুর পাল। তবে এই বর্ষায় অনেকে বাড়িতে না ঢুকে গরুর পাল নিয়ে পদ্মার চর এলাকায়ও যান। সাধারণত রাখালেরা আশ্বিন-কার্তিক ও মাঘ-ফাল্গুন মাসে বাড়িতে রেখেই গরু ও বাছুর পালন করেন। তবে একেবারে মাঠের ঘাসের ওপর নির্ভর করলে চলে না তাঁদের। কিনতে হয় খেসারির খেত।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, রাখালের দল ও গরুর পালের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জেলার বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চল ও পদ্মার চরে অসংখ্য গরুর পাল বছরের সাত-আট মাস চরে বেড়ায়। গরুকে খাওয়ানোর জন্য তেমন খরচ না লাগায় রাখাল দলের কাছে গরু পালন লাভজনক হয়। তবে এ জন্য তাঁদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় কষ্টকর পরিবেশে থেকে। দুধের বড় একটি অংশ তাঁদের কাছ থেকে আসে।