শিগগির আসছে না ওষুধ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শিগগির মশা মারার নতুন ওষুধ আসছে না। ওষুধ কবে আসবে, তাও সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারছে না। 

তবে ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করা, নমুনা পরীক্ষায় তা উত্তীর্ণ হলে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা, দেশে আনার পর আরেক দফা ওষুধ পরীক্ষার পর তা ছিটানোর উপযোগী করার মতো কাজগুলো সম্পন্ন করতে এ মাসের পুরোটা লেগে যেতে পারে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, গবেষক, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ আসার এই বিলম্বের কথা জানা গেছে। নতুন ওষুধ ব্যবহারের আগ পর্যন্ত অকার্যকর পুরোনো ওষুধই ছিটাবে দুই সিটি করপোরেশন। 

গত সপ্তাহে একাধিক অনুষ্ঠানে ঢাকার দুই সিটির মেয়র দ্রুত নতুন ওষুধ আনার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছেন এমন কথাও তাঁরা বলেছেন। ১ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ডেঙ্গুবিষয়ক সমন্বয় সভায় দুই মেয়রের সঙ্গে এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদও উপস্থিত ছিলেন। সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না করলেও দ্রুত ওষুধ আনার কথা বলেছিলেন। আর দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন। 

বিগত কয়েক বছরের হিসাবে দেখা গেছে, বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। এরই মধ্যে সরকারি হিসাবে এ বছর জুলাই মাসে আগের সব রেকর্ড ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ১৫ হাজার ৬৫০। ২০১৮ সালে সারা বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ১০ হাজার ১৪৮। মৃত্যুর সংখ্যাও গত বছরের তুলনায় বেশি। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও রোগীর স্বজনদের কথা বলে প্রথম আলো এ বছর ৮৫ জনের মৃত্যুর খবর জেনেছে। সরকারি হিসাবে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে একটি সংকট চলছে। এখন সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে অতি দ্রুততার সঙ্গে মশার ওষুধ আনার ব্যবস্থা করা।

ওষুধ কত দূরে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নতুন একটি ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করেছে। আরও একাধিক নমুনা পরীক্ষা করবে বলে কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। আর উত্তর সিটি করপোরেশনের ওষুধের নমুনা গতকাল আসার কথা ছিল। পরীক্ষা শেষে ওষুধ আমদানি করবে। তারপর তা ছিটানোর উপযোগী করা হবে। 

উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে মশা মারার ওষুধ আনছে। ৪ আগস্ট রাতে ওষুধের নমুনা আসবে। এসব নমুনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এলসির মাধ্যমে আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হবে।

মশার ওষুধ দুটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রোটেকশন উয়িং ওষুধের রাসায়নিক পরীক্ষা করে। এতে সময় লাগে এক-দুই দিন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কীটনাশক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্লান্ট প্রোটেকশন ইউনিটে নিবন্ধন করেছে। পণ্য আমদানির সব নিয়মনীতি অনুসরণ করে তারা মশার ওষুধ আমদানি করবে। তবে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ ব্যবস্থার ওষুধ আনছে না। 

>নতুন ওষুধ ব্যবহারের আগ পর্যন্ত অকার্যকর পুরোনো ওষুধই ছিটাবে দুই সিটি করপোরেশন

আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) মশা মারতে তা কার্যকর কি না, সেই পরীক্ষা করে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেছেন, ওষুধ পরীক্ষায় ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে।

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ওষুধ আমদানির ছাড়পত্র পাবে সিটি করপোরেশন। তখন তারা এলসি খুলবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোথাও বিলম্ব না হলেও কমপক্ষে ১০ দিন সময় রাগবে ওষুধের কাঁচামাল দেশে পৌঁছাতে। 

তবে এসব প্রক্রিয়া শেষে ওষুধ পৌঁছাতে কত দিন লাগবে, তা বলেননি উত্তরের মেয়র। তিনি বলেছেন, নির্দিষ্ট সময় বলা যাচ্ছে না।

কারখানা নেই

উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের ওষুধবিষয়ক কারিগরি কমিটি ডেল্টামেথ্রিন, ম্যালাথিউন, সোসিয়ামসহ ছয়-সাতটি রাসায়নিকের তালিকা দিয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী ওষুধ আনা হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধ কেনা হচ্ছে, তার নাম তিনি বলেননি। 

চীন, ভারত ও সিঙ্গাপুর থেকে কাঁচামাল এনে দেশেই মশার ওষুধ তৈরি করবে উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কোনো কারখানা নেই। কোথায় ওষুধ বানাবেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ভান্ডার কর্মকর্তা আব্দুল বাছেত প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের পৃথক কোনো জায়গা বা কারখানা নেই। তিনি জানেন না ওষুধ কোথায় কেরোসিন বা ডিজেলে মিশিয়ে ব্যবহার উপযোগী করা হবে।

 দুই সিটিতে ফারাক

উত্তরের মেয়র বলেছেন, এক মাস চলবে এমন ওষুধ তাঁদের মজুত আছে। নতুন ওষুধ আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা এই ওষুধ ব্যবহার করবেন। 

এর আগে ১ আগস্ট আতিকুল ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভায় বলেছিলেন, একটি কোম্পানির ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় ওই কোম্পানির ওষুধ বাতিল করা হয়। ওই কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছে। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ওই ওষুধ ছিল লিমিট অ্যাগ্রোপ্রডাক্ট নামের একটি কোম্পানির। উত্তরের বাদ দেওয়া ওই ওষুধ কিনে নিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। লিমিট বহু আগ থেকেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ব্যবসা করা আসছে। 

ছয় মাস আগে লিমিট নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডের মাধ্যমে ৬৫ হাজার লিটার ওষুধ দক্ষিণ সিটিকে দিয়েছিল। বর্তমানে তার কিছু অবশিষ্ট আছে বলে ভান্ডার বিভাগ জানিয়েছে। জুলাইয়ের ১৫ তারিখে আরও ৪০ হাজার লিটার তারা সরবরাহ করেছে বলে জানা গেছে।

পরীক্ষায় ব্যস্ত দক্ষিণ সিটি

৩ আগস্ট দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাঠপর্যায়ে লিমিটের ওষুধ পরীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গেছে, ওষুধ মশানিধনে কার্যকর। এখন তারা এই ওষুধ প্লান্ট প্রোটেকশন উয়িং ও আইইডিসিআরে পাঠাবে পরীক্ষার জন্য। 

এর আগে ২ আগস্ট দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের কীটনাশক পরীক্ষা করেছিল। তাকেও কার্যকর বলেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। 

তবে নতুন ওষুধের ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আহম্মেদ। 

অন্যদিকে প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা নুরুজ্জামান চারটি ওষুধের একটি তালিকা দিয়ে বলেন, ‘এই চারটি ওষুধ পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ওষুধটি আমরা নেব।’ তবে কোন কোম্পানির ওষুধ বা কবে তাঁরা ওষুধ নেবেন, তার কিছুই তিনি বলেননি।

২০১৮ সালে আইসিডিডিআরবি পরীক্ষা করে দেখে, মশার ওষুধ অকার্যকর। এরপর সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ওষুধ পরীক্ষা করে একই কথা বলে। দুটি পরীক্ষার ফলাফল দুই সিটির কর্মকর্তারা জানতেন। অন্যদিকে মার্চ মাসে দুই সিটির ১০০টি এলাকায় মশা জরিপ করে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলেছিল, এ বছর এডিশ মশা বাড়বে, মশা নিধন না করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। এরপর এপ্রিল মাসে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বিষয়টি জানানো হয়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন যখন কোনো কীটনাশক ব্যবহার হয়, তখন তা কার্যকারিতা হারায়। কারণ, তা সহনশীল হয়।

এই গবেষক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কীটনাশকবিষয়ক কারিগরি কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, নতুন কীটনাশক কাজ দেবে। এটা বিশ্বে মশকনিধনে ব্যবহৃত হয়।