নদীর তাণ্ডবে বেসামাল শেরপুরের জনপদ

ব্রহ্মপুত্র নদের অব্যাহত ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে নকলার নারায়ণখোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত শুক্রবার দুপুরে।  প্রথম আলো
ব্রহ্মপুত্র নদের অব্যাহত ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে নকলার নারায়ণখোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত শুক্রবার দুপুরে। প্রথম আলো

নকলার চর অষ্টধর ও চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চারটি গ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও মৃগী নদীর অব্যাহত ভাঙনে দুই বছরে মসজিদ, কবরস্থান, রাস্তা, ফসলি জমিসহ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ভয়াবহ ভাঙনে নারায়ণ খোলা দক্ষিণ জামে মসজিদ ও কবরস্থান এবং মৃগী নদীর ভাঙনে চন্দ্রকোনা-দড়িপাড়া সড়কের একাংশ নদী গ্রাস করে নিয়েছে। বর্তমানে নারায়ণ খোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ১০টি বাড়ি ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। কিন্তু ভাঙনরোধে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

গত শুক্রবার নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, দুই বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে নকলা উপজেলার নারায়ণ খোলা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর প্রান্তে নদের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বর্ষা মৌসুমে নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ও প্রবল স্রোতে নারায়ণ খোলা গ্রামে নদের ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নদের ভাঙনে এ গ্রামের অর্ধশত বছরের প্রাচীন জামে মসজিদ, কবরস্থানসহ বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ও বিপুলসংখ্যক গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে নারায়ণ খোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ১০টি বাড়ি ভাঙনের হুমকির মুখে।

ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর ভাঙনে বাছুর আলগা দক্ষিণ পাড়া, চকবড়ইগাছি ও চরমধুয়া নামাপাড়া গ্রামের অন্তত ২০টি বাড়ি, চন্দ্রকোনা-দড়িপাড়া সড়কের একাংশ ও চিকারবাড়ি ঘাটসংলগ্ন ৫০ মিটার সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব গৃহহীন মানুষ অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেউবা নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যত্র চলে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে নারায়ণ খোলা দক্ষিণ গ্রামের বিশাল অংশ নদী গ্রাস করে নিয়েছে। নারায়ণ খোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে এটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ভাঙনের ঝুঁকির মুখে থাকা কয়েকটি পরিবার তাঁদের ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে।

নদীভাঙনের শিকার নারায়ণ খোলা দক্ষিণ গ্রামের মো. শামছুল হক বলেন, দুই বছরে নদের ভাঙনে শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, কবরস্থান, ফসলি জমি ও বিপুলসংখ্যক গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে ১০টি বাড়ি ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। তাঁরা এখন বাড়িঘর দূরবর্তী স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। এলাকাবাসী ভাঙন–আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

নারায়ণ খোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শামছুন নাহার বলেন, তাঁর বিদ্যালয়টি নদের ভাঙনের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। যেকোনো সময় এটি নদে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ভাঙনের বিষয়টি তিনি ইউএনও ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।

নারায়ণ খোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিদাতা সদস্য দেলোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। কয়েক বছর যাবৎই নদীটি ভাঙছে। কিন্তু এ বছর ভাঙনের তীব্রতা বেশি। তবে ভাঙনরোধে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মৃগী নদীর ভাঙনে গৃহহীন চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুর আলগা দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত নুর রহমানের স্ত্রী আছিয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দুই যুগ আগে তিনি বিধবা হয়েছেন। ৫ শতাংশ জমিতে ছোট একটি ঘরে খেয়ে না–খেয়ে দিন কাটাতেন। সেটিও নদী কেড়ে নিয়েছে। এখন কোথায় থাকবেন, কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

চকবড়ইগাছি গ্রামের আফাজ উদ্দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালান। পরিবার নিয়ে ১০ শতাংশ জমিতে ঘর তৈরি করে বসবাস করতেন তিনি। কিন্তু মৃগী নদীর ভাঙনে সেই ঘরটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন পরিবার নিয়ে থাকার মতো জায়গা নেই। সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।

বাছুর আলগা দক্ষিণপাড়া গ্রামের মাহবুবর রহমানসহ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল স্রোত এবং শুকনো মৌসুমে খননযন্ত্র দিয়ে একটি প্রভাবশালী মহলের অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নারায়ণ খোলা ও চন্দ্রকোনা গ্রামে নদের ভাঙন তীব্র হয়েছে। তাঁরা ভাঙনরোধে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান।

এ বিষয়ে নকলার ইউএনও জাহিদুর রহমান বলেন, তিনি ইতিমধ্যে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থানান্তরের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। পাউবো শেরপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ভাঙনরোধে ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ নির্মাণে পাউবোর পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।