রোহিঙ্গা ফেরাতে মিয়ানমারের হঠাৎ এত আগ্রহ কেন

রোহিঙ্গা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার মতো পরিবেশ রাখাইনে ফেরেনি, বাংলাদেশে এসে স্পষ্ট করেই তা বলে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত। এরপরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমার আবার আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণ বৈশ্বিক চাপ। 

কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাখাইনে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ চার পদস্থ সেনা কর্মকর্তার ওপর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে নতুন করে চাপে ফেলেছে। রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্ত শুরুর প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হচ্ছে মিয়ানমারকে।

মিয়ানমার ঘুরেই গত ২২ জুলাই জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গনার ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর ঢাকা ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে চীন, জাপান, মিয়ানমার এবং আসিয়ানের (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের আঞ্চলিক জোট) প্রতিনিধিদল। কূটনীতিকেরা বলছেন, হঠাৎ কিছুটা চাপে পড়ায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। 

আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক এসব চাপ সামলে নিতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা আবার শুরু করেছে দেশটি। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে চীন। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের এখনই রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরু করতে চায় চীন। দেশটি মনে করে, এখনই শুরু করা না গেলে প্রত্যাবাসন খুব সহজে করা যাবে না। 

মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল জুলাইয়ের ২৭ তারিখ ঢাকায় এসেই কক্সবাজার ছুটে যায়। ২৯ জুলাই ঢাকা ছাড়ার আগে প্রতিনিধিদলটি আলোচনা করে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, বাহ্যিকভাবে তাদের কিছুটা নমনীয় মনে হলেও তারা আগের অবস্থানেই আছে। যেনতেনভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করাটাই তাদের লক্ষ্য। মিয়ানমার বাইরের বিশ্বে দেখাতে চাইছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা আন্তরিক। বাংলাদেশ কিছুই করছে না। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের এই সফরকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা এবার মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নাগরিকত্বের বিষয়ে কথা বলেছে, যা এর আগে কখনো তারা পারেনি।

 চীনের প্রভাব ও বৈশ্বিক চাপ প্রশমন 

গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের সময়ই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য কক্সবাজারে প্রতিনিধি পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিল মিয়ানমার। বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কিকিয়াংসহ দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকার কথা প্রথমবারের মতো এসেছে। বিবৃতির ১৯ অনুচ্ছেদে প্রসঙ্গটি এলেও সেখানে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উহ্য রেখে বলা হয়েছে ‘মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেছে চীন। 

এরই ধারাবাহিকতায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক উ জিংহাউয়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল ২৪ ও ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সফর করে। রাখাইনে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য চীন যে মিয়ানমারকে বলেছে, সেটিও উ জিংহাউ বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের জানিয়ে যান।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখনই মিয়ানমারকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়াতে মিয়ানমার তার অঙ্গীকার কতটা পূরণ করছে, সেটা প্রতিটি ধাপে মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক নজরদারির প্রয়োজন আছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, ইইউ, আসিয়ান—সবাইকে নিয়েই বাংলাদেশকে এগোতে হবে।

 ভূমিকা রাখতে আগ্রহী জাপান

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই এর সমাধানে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে আসছে জাপান। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে এ নিয়ে তিন দফায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো। প্রতিবারই তিনি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমার গেছেন। সর্বশেষ গত বুধবার তিনি নেপিডোতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করে, এ সমস্যা সমাধানে যা কিছু করা সম্ভব তার সবই করার আশ্বাস দিয়েছেন। এর আগে তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর মন্ত্রী বলেন, জাপান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা টোকিওতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ডেকে মধ্যস্থতা করতে চায়।

অস্থিতিশীলতায় উদ্বিগ্ন আসিয়ান

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। আসিয়ানের এই চার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র মনে করে, রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তা মিয়ানমারের অখণ্ডতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার বছরখানেক না যেতেই রাখাইনে হামলা শুরু করেছে আরাকান আর্মি। আবার শানসহ বিভিন্ন জায়গায় আছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপস্থিতি। মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে একে অন্যের কাছাকাছি আসতে সহায়তা করবে। শেষ পর্যন্ত এটি ঘটলে তা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। 

দায়িত্বশীল একটি সরকারি সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন বিন আবদুল্লাহ মিয়ানমার নিয়ে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে গেছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘসূত্রতার কৌশলটা মিয়ানমার ভালোই শিখেছে। বিশ্বকে দেখাচ্ছে, আমরা তো বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছি। তোমরা অধৈর্য হচ্ছ কেন? রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হলে মিয়ানমারকে ’৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। নাগরিকত্ব নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা এলেই শুধু রোহিঙ্গারা আশ্বস্ত হতে পারে।’ 

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে রাখাইনে গণহত্যার কথাটা জোরের সঙ্গেই আসছে। মিয়ানমারের ওপর একটা চাপ তৈরি হচ্ছে। তবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান চীন, ভারত সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।