দুর্ঘটনা রোধে সব পক্ষের সচেতনতা প্রয়োজন

সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ। তাঁর ডান পাশে উবার বাংলাদেশের প্রধান জুলকার কাজী ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারের প্রথম আলোর কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ। তাঁর ডান পাশে উবার বাংলাদেশের প্রধান জুলকার কাজী ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারের প্রথম আলোর কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষের দায়িত্ব নয়। সরকার, নীতিনির্ধারক, পুলিশ, গণমাধ্যম, ব্যক্তিপর্যায়সহ সব পক্ষেরই এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। সব পক্ষের সচেতনতা, জনসচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগই পারে সড়কে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল সোমবার সকালে ‘সড়ক নিরাপত্তায় চাই সমন্বিত উদ্যোগ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন আলোচকেরা। 

দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সড়কে আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে জোর দিতে চান জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ। তিনি বলেন, ৯৯৯–এ প্রচুর ফোন আসে সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত। এ ছাড়া অনেকে সড়কে হয়রানির শিকার হয়েছেন জানিয়ে ফোন করেন। জরুরি মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসকে একসঙ্গে সমন্বয় করতে হয়।

উবার বাংলাদেশের প্রধান জুলকার কাজী ইসলাম বলেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কারও একার নয়। সব অংশীজনের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, যাত্রীদের জন্য সড়কে নিরাপত্তা বিষয়টিকে উবার মৌলিক নীতি হিসেবে বিবেচনা করে। নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত হয়েই মানুষ উবারের মাধ্যমে একেবারে অপরিচিত চালকের গাড়ি ব্যবহার করছে। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালকদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ উবার নিয়েছে বলে জানান তিনি।

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্ভরযোগ্য ও সঠিক তথ্যভান্ডার করা জরুরি বলে জানান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের পরিচালক (অপারেশনস) সেলিম মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সড়কে মৃত্যুর হার কমেনি বরং একটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। 

দুর্ঘটনা কমাতে পথচারীদের সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন। তিনি বলেন, পথচারীরা জানে না কোন পথ দিয়ে হাঁটবে, কীভাবে হাঁটবে—এসব নিয়ে সচেতনতা খুবই কম। পাঠ্যপুস্তকে নবম–দশম শ্রেণি পর্যন্ত সড়কে নিরাপদ চলাচলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিব উল আলম বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই চালকদের ১০ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে গাড়ি চালাতে হয়। এ কারণে চালকের ভুল করার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তা ছাড়া চালকদের মধ্যেও একটা প্রতিযোগিতা থাকে বাড়তি উপার্জন করার। এ পদ্ধতিটা ঠিক করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। তিনি বলেন, সরকার চাপে পড়ে সড়ক নিরাপত্তা আইন করেছে। তবে এই আইন যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে না। সরকারেরও সচেতনতার অভাব আছে এ ক্ষেত্রে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে সড়কে এত মৃত্যু হতো না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন বলেন, সড়কে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিদের শারীরিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে আহত ব্যক্তিদের মানসিক চিকিৎসার বিষয়টি আড়ালে থেকে যায়। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যে ট্রমার মধ্য দিয়ে আহত ব্যক্তিদের যেতে হয়, সেটার প্রতি নজর দেওয়াও জরুরি। 

নিরাপদ সড়কের ক্ষেত্রে বহু জায়গায় ঘাটতি দেখেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তিনি বলেন, রাস্তা যথাযথ নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয় না। বেশির ভাগ চালক সঠিক প্রশিক্ষণ পান না। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ১১১টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এসব সুপারিশ মানা হলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপির ফিজিওথেরাপি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ফারজানা শারমিন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করে সিআরপি। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার দায় শুধু চালকদের নয়। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যাত্রীরও দায়িত্ব আছে। একজন আরেকজনকে দোষ না দিয়ে দুই পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে হবে।

বৈঠকে বক্তব্য দেন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের নারীবিষয়ক সম্পাদক মঞ্জুলী কাজী। তিনি বলেন, দেশে সড়ক নিরাপত্তার আইনগুলোর প্রয়োগ খুব শিথিল। সবচেয়ে বেশি দরকার বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা তৈরি করা। মঞ্জুলী কাজীর স্বামী শিক্ষক–সাংবাদিক মিশুক মুনীর ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদসহ অরও চারজন। তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে সবাই নিহত হন।

দুঃসহ সেই স্মৃতি স্মরণ করে মঞ্জুলী কাজী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আমার স্বামীকে হারিয়েছি। ওই দুর্ঘটনার কারণ ছিল, বাসচালক পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে আবার গাড়ি চালাচ্ছিলেন।’

বৈঠকে উবারের পাবলিক পলিসি (বাংলাদেশ-ভারত) বিভাগের প্রধান ইরাবতী দামলে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকার করেছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে সুশীল সমাজও বেশ সক্রিয়। হেলমেট ব্যবহার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগ সড়কে দুর্ঘটনা কমাবে।