ঢাকায় শ্বেতশুভ্র দোলনচাঁপার সৌরভ

বর্ষার ফুল দোলনচাঁপা। গত রোববার শাহবাগের একটি ফুলের দোকানে।  ছবি: প্রথম আলো
বর্ষার ফুল দোলনচাঁপা। গত রোববার শাহবাগের একটি ফুলের দোকানে। ছবি: প্রথম আলো

শেষ বিকেলে থমথমে হয়ে আছে বর্ষার আকাশ। একটু আগে সামান্য বৃষ্টি হয়ে গেলেও অস্বস্তিকর গরম কাটেনি। এর মধ্যেই খামারবাড়ি মোড়ে যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় পেট্রল পোড়া গন্ধ ছাপিয়ে নাকে এল তীব্র সুগন্ধ। দেখা গেল, হাতে কয়েকটি দোলনচাঁপার তোড়া নিয়ে গাড়ির জানালায় টোকা দিচ্ছে ফুল বিক্রেতা দুই কিশোরী।

শ্বেতশুভ্র দোলনচাঁপা এমনই এক ফুল, তীব্র সুগন্ধই যার অস্তিত্ব জানান দেয়। এখন দোলনচাঁপা ফুল ফোটার সময়। নগরের ফুলের দোকানগুলোতে বাহারি জাতের ও বহু বর্ণের ফুলের দেখা মিললেও বেশির ভাগ ফুলেরই কোনো সৌরভ থাকে না। তবে যে দোকানে দোলনচাঁপা বিক্রি হচ্ছে, সেই দোকানসহ আশপাশের বাতাসেও এই ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

শাহবাগের ফুলের বাজার, ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের মোড় কিংবা বিজয় সরণি এলাকায় এখন অনেক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার হাতে দেখা মিলবে দোলনচাঁপার। সাধারণত প্রতি তোড়ায় ১০টি করে ফুলের ডাঁটা থাকে। নগরের অনেক বাসিন্দাই এই ফুলের অনুরক্ত। তাই অনেকে বসার কিংবা শোবার ঘরে প্রাকৃতিক সুগন্ধে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়মিত এই ফুল কেনেন। ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে দরাদরি করে প্রতি তোড়া ফুল ৬০-৭০ টাকায় কেনা যাবে। তবে ফুলের দোকান থেকে কিনতে গেলে খানিকটা বেশি দাম পড়বে। এ ছাড়া রমনা উদ্যান, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানসহ আগারগাঁওয়ের নার্সারিগুলোতে গাছে ধরা ফুটন্ত ফুল দেখতে পাওয়া সম্ভব।

সাভারসহ ঢাকার আশপাশে অনেক ফুলচাষি এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দোলনচাঁপার চাষ করেন। দোলনচাঁপা সাধারণত সন্ধ্যায় ফোটে। রাতের বেলায় এর সৌরভ আরও বেড়ে যায়। মূলত বর্ষার ফুল হলেও শরতেও ফোটে এই ফুল। ইদানীং বাড়ির ছাদে অনেকে শখ করে দোলনচাঁপার গাছ লাগান।

দোলনচাঁপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘যেন দেবকুমারীর শুভ্র হাসি, ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি’। ১৯২৩ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামও তিনি রেখেছিলেন দোলনচাঁপা। আবার ‘হৃদয়-আকাশে প্রেমের দোলনচাঁপায়’ দোল খাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের গানেও।

দোলনচাঁপা হচ্ছে বহুবর্ষজীবী কন্দজাতীয় উদ্ভিদ। এটি ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে এর পুষ্পমঞ্জরি। ফুল ফোটার সময় হলে প্রতিটি শাখার মাথায় থোকা থোকা ফুল বের হয়, যা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। তাই কিউবাতে এই ফুল পরিচিত বাটারফ্লাই জিনজার লিলি নামে।

দোলনচাঁপার বৈজ্ঞানিক নাম Hedychium Coronarium। ইংরেজি নামের মধ্যে হোয়াইট জিনজার লিলিও উল্লেখযোগ্য। মণিপুরি
ভাষায় দোলনচাঁপা হচ্ছে ‘তখেল্লৈ অঙৌভা’। ‘সোনটাকা’ এর মারাঠি নাম। আসামে দোলনচাঁপা হলো ‘সুরুলি সুগন্ধি’। সমতল ও পাহাড়—দুই জায়গাতেই ভালো হয় দোলনচাঁপা। এর আদি বাড়ি উত্তর ভারতে।

দোলনচাঁপা গাছ দেখতে অনেকটা আদা কিংবা হলুদগাছের মতো। ফুল ফোটা শেষ হলে শীতে কন্দ শুকিয়ে যায়। গ্রীষ্মে দুয়েক পশলা বৃষ্টি হলে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গাছ। সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না, এমন জায়গায় ভালো জন্মে। গাছ থেকে কেটে নেওয়ার পর দোলনচাঁপা তাজা থাকে খুব অল্প সময়। তারপরও যতক্ষণ টিকে থাকে, মনমাতানো সুরভিতে মাতিয়ে রাখে চারপাশ।