দোলনাটা এল ঠিকই, শুধু ইরতিজা নেই

২৬ জুলাই ছিল ইরতিজার জন্মদিন। মায়ের কাছে বায়না ছিল দোলনার। দোলনা এসেছে। কিন্তু সে দোলনা দেখা বা চড়া হয়নি শিশুটির। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জুলাই ইরতিজা চলে যায় না–ফেরার দেশে। ডেঙ্গু আক্রান্ত মা সেই দোলনার পাশে। গতকাল ধানমন্ডিতে।  ছবি: হাসান রাজা
২৬ জুলাই ছিল ইরতিজার জন্মদিন। মায়ের কাছে বায়না ছিল দোলনার। দোলনা এসেছে। কিন্তু সে দোলনা দেখা বা চড়া হয়নি শিশুটির। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জুলাই ইরতিজা চলে যায় না–ফেরার দেশে। ডেঙ্গু আক্রান্ত মা সেই দোলনার পাশে। গতকাল ধানমন্ডিতে। ছবি: হাসান রাজা
>জন্মদিনে দোলনার আবদার করেছিল শিশুটি, জন্মদিনের ঘণ্টা কয়েক আগে সেটি বাসায়ও আসে। তার আগেই মারা যায় শিশুটি।

গত ২৩ জুলাই ইরতিজা শাহাদের সাত বছর পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। জন্মদিনে দোলনার আবদার করেছিল শিশুটি। মা-ছেলে মিলে ঘাঁটাঘাঁটি করে অনলাইনে পছন্দসই দোলনার ফরমাশ দেয়। জন্মদিনের কয়েক ঘণ্টা আগে দোলনা আসে, কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তার আগে মারা যায় ছোট্ট ইরতিজা।

খাবার টেবিলের পাশে দাঁড় করানো দোলনাটি দেখিয়ে ইরতিজার মা চাঁদ সুলতানা চৌধুরানী ছেলের জন্মদিন নিয়ে এই স্মৃতিচারণা করেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ-কর কমিশনার চাঁদ সুলতানা বলেন, ‘ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দোলনায় বসা দূরের কথা, একবার চোখেও দেখতে পেল না ছেলেটা।’

গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকে ধানমন্ডির বাসায় বসে কথা হয় ইরতিজার বাবা-মায়ের সঙ্গে। এর কিছুক্ষণ আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছয় দিন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরেন চাঁদ সুলতানা। ইরতিজার বড় বোন সামাইরা ফারজিন ২০১৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। ডেঙ্গুর ভয়ে চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্রীকে আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত দুই মাসে এই অ্যাপার্টমেন্টের নয়জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন বলে জানা গেছে।

হাসপাতালে অবস্থানকালে চাঁদ সুলতানা ৫ আগস্ট তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাননীয় মেয়র...ডেঙ্গু জ্বরে আমি আমার প্রাণের অধিক প্রিয় একমাত্র ছেলেকে হারালাম। এখন আমিও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ছয় দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছি। আমার মেয়ের দুই বছর বয়সে ডেঙ্গু হয়েছিল। আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারেন আমার মেয়ের আর ডেঙ্গু হবে না?...নাকি এই লেখাটিও আপনার কাছে একটি গুজব।’ তাঁর সেই পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়।

ইরতিজা শাহাদ
ইরতিজা শাহাদ

চাঁদ সুলতানা সন্তান হারানোর শোক, জ্বরের ধকল—কোনোটাই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কথা বলার সময় একটু পরপর তিনি সোফায় শরীর এলিয়ে দিচ্ছিলেন।

ইরতিজার অভিভাবকেরা জানান, ১ জুলাই ১০২ ডিগ্রি জ্বর আসে ইরতিজার। চিকিৎসক বাবা মো. শাহেদ রফি প্যারাসিটামল খাওয়ালে ও গা মুছিয়ে দিলে জ্বর ছেড়ে যায়। পরে ৩ জুলাই মধ্যরাতে পেটে ব্যথা উঠলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ জুলাই দুপুরে শিশুটি মারা যায়।

বাসাজুড়ে ইরতিজার উপস্থিতি। কত শত গল্প স্বজনদের। ইরতিজার একটি খাতা হাতে হাজির হন তার নানি উম্মে হাবিবা চৌধুরী। সেখানে কমলা রঙের কালিতে ‘মাই বার্থ ডে পার্টি’ শিরোনামে লেখা ‘এভরি ইয়ার মাই প্যারেন্টস অ্যারেঞ্জ মাই বার্থডে পার্টি অ্যাট হোম। আ চকলেট কেক ইজ অর্ডারড ফর মি।’ এবারের জন্মদিন নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল ছোট্ট ছেলেটির।

নিজের শোবার ঘর থেকে ইরতিজার স্কুলের নতুন আইডি কার্ড নিয়ে আসেন বাবা। ঘরে নতুন স্কুল ড্রেসও পড়ে আছে। ইরতিজার প্রথম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে গত ১২ জুলাই। অথচ নতুন ক্লাসে যাওয়া হয়নি। তার আগে মশার কামড়ে ইরতিজাকে ঠাঁই নিতে হয়েছিল হাসপাতালে।

ইরতিজার ছোট্ট পড়ার টেবিল সুপারম্যানের আদলে গড়া। দেয়ালেও সুপারম্যানের স্টিকার। চেয়ারে স্কুলব্যাগ। টেবিলের ওপর ইরতিজার ছবি, বই, খাতা, বইয়ের পাশে রঙিন কয়েন বক্স। তাতে বেশ কিছু খুচরা পয়সা। টেবিলে হুমায়ূন আহমেদের চেরাগের দৈত্য এবং বাবলু, ইশপের গল্পসহ বেশ কিছু বাংলা গল্পের বই।

টেবিল ভর্তি বাংলা বইয়ের উত্তর মেলে দরজার ওপর সাঁটা কারুকার্যে। মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমে এই ছাত্রের মাই নিউ ইয়ার রেজল্যুশনে (২০১৯) লেখা ছিল ‘বাংলায় ভালো করা।’ মা বলেন, রেজল্যুশন পূর্ণ করার সময় পেল না ছেলেটি। অথচ বন্ধের সময় সে বাংলা শিখতে চেয়েছিল। ইরতিজার স্বপ্ন ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার। ওর আঁকা ছবি আছে টেবিলের খাতায়, ঘরের দেয়ালে, দরজার গায়ে।

ইরতিজা হাসপাতালে ভর্তির পরে সব খেলনা পলিথিনে মুড়ে রেখেছিল বোন, যাতে নষ্ট না হয়। কিন্তু সে খেলনাগুলো ইরতিজা ছুঁয়ে দেখবে না বলে মন খারাপ করেন নানি। নীল রঙের সাইকেলটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ইরতিজা আর কখনো সাইকেল নিয়ে ছুটবে না। ডেঙ্গু ইরতিজাকে চিরতরে থামিয়ে দিল।

বাবা মো. শাহেদ রফি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতা আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ছেলেটি হারিয়েছি।’ এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুকে গুজব বলা বন্ধ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করুন। বাবা-মায়ের আর বুক খালি করবেন না, প্লিজ। এ কথার পরে ইরতিজার বাবা-মা একে অন্যের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন।