টাকা বরাদ্দেই বড় গলদ

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গলদ রয়েছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, বাস্তবতার নিরিখে অনেক প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এ কারণে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পে বিশাল বরাদ্দ নিয়ে খরচ করতে পারে না। আবার বহু প্রকল্পে চাহিদামতো টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। 

এডিপির প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সেই মন্ত্রণালয়ই প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ ও খরচের ক্ষেত্রে এ সামঞ্জস্যহীনতার কথা বলছে। তবে এ সামঞ্জস্যহীনতা নিরসনে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুব বেশি নেই। গতকাল মঙ্গলবার বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপি পর্যালোচনা সভায় প্রকল্পের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হয়। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে এডিপির সমস্যা তুলে ধরে একটি উপস্থাপনা দেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুল আমিন। শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। 

সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সার্বিকভাবে বিদায়ী অর্থবছরে এক-তৃতীয়াংশ প্রকল্পে বরাদ্দ কমাতে বা বাড়াতে হয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার পরও অনেক প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদায়ী অর্থবছরে এমন প্রকল্প ছিল ৪৮টি। আবার দুটি মন্ত্রণালয় বরাদ্দের বেশি টাকা খরচ করেছে, যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। প্রকল্প পাসের সময় ছোট কলেবরের প্রকল্প নেওয়া হলেও পরে ধীরে ধীরে সংশোধন করে খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। 

সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সিসি ক্যামেরা বসিয়ে প্রকল্পের কাজ তদারক করা হবে। এখন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রকল্প সিসি ক্যামেরা বসিয়ে তদারক করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কোনো প্রকল্প তৃতীয়বার সংশোধনের প্রস্তাব আনা হলে তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হবে। 

প্রকল্পের যত সমস্যা

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা অনুসারে বেশ কিছু মন্ত্রণালয় তাদের নির্ধারিত বরাদ্দ সীমার বাইরে গিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এতে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরও গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির ৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা খরচ সম্ভব হয়নি। এর মানে, বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্পের চাহিদা নির্ধারিত হয়নি। তাই মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর বরাদ্দ সীমার বাইরে গিয়ে প্রকল্প না নেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। 

পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকার পরও নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প শেষ না হওয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে মন্ত্রণালয় বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে ৩৪৫টি প্রকল্প শেষ করার জন্য নির্ধারিত ছিল। বরাদ্দ দেওয়ার পরও ৪৮টি প্রকল্প শেষ হয়নি। এসব প্রকল্পে চলতি এডিপিতে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। 

বিদায়ী অর্থবছরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তাদের ১১৭টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের চেয়ে ৬৬ কোটি টাকা বেশি খরচ করেছে। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২৯টি প্রকল্পে বরাদ্দের চেয়ে ২ কোটি টাকা বেশি খরচ করেছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ করার কোনো সুযোগ নেই, যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আরও বলছে, প্রাথমিকভাবে ছোট কলেবরে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে কলেবর বৃদ্ধি করে প্রকল্প খরচ ও মেয়াদ বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। এতে অন্য চলমান প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না এবং জনগণ প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ হলো কলেবর বৃদ্ধি না করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা। 

প্রকল্পের সময় ও মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্প অনুমোদনের পর বাস্তবায়নকালে শিডিউল রেট পরিবর্তন, স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মপরিধি বৃদ্ধির কারণে প্রায় সব প্রকল্পই এক বা একাধিকবার সংশোধন করা হয়। 

বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে ১ হাজার ৭৬৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৬০৫টি প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো বা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই চলতি অর্থবছরে আগামী ২০ মের পর কোনো সংশোধনী প্রস্তাব নেবে না বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। গত অর্থবছরে এডিপির ৯৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গতবার সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। 

প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হবে

বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কোনো প্রকল্প একবার সংশোধন হতে পারে। তবে দুই কিংবা তিনবার সংশোধন কাম্য নয়। তিনবার প্রকল্প সংশোধন স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তিনবার প্রকল্প সংশোধন প্রস্তাব করলে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হবে। 

চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের তদারকি আরও বাড়বে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। জানান তিনি, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ নিয়মিত মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখবে। অহেতুক জমির অধিগ্রহণে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।