শ্রমিক নিয়োগে ঘুষ ও কাজ না করেই অর্থ লোপাট?

গাইবান্ধা
গাইবান্ধা

গাইবান্ধায় অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) কাজে শ্রমিক নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া কাগজে-কলমে মাটির কাজ সম্পন্ন দেখানো হলেও রাস্তায় কাজের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কিছু কাজ হয়েছে যেনতেনভাবে। অন্তত ১০টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার ৭টি উপজেলার ৮২টি ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির কাজের জন্য ২৮ হাজার ৮৪৫ জন শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। এসব শ্রমিকের মজুরি বাবদ ২৪ কোটি ৪৯ লাখ ২১ হাজার ৬৮৩ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ৫ হাজার ৬১৭ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৬ টাকা, গাইবান্ধা সদরে ৪ হাজার ৩৯১ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৩ কোটি ৭২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, সাদুল্যাপুরে ৩ হাজার ৮৮৯ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৩ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৮০৬ টাকা, পলাশবাড়ীতে ২ হাজার ৯১০ জন শ্রমিকের বিপরীতে ২ কোটি ৪৭ লাখ ৩১ হাজার ৮৬২ টাকা, গোবিন্দগঞ্জে ৫ হাজার ৭৩৭ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৪ কোটি ৮৭ লাখ ১৬ হাজার ৫৮৭ টাকা, সাঘাটায় ৩ হাজার ৭৫২ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৯ টাকা এবং ফুলছড়িতে ২ হাজার ৪৪৯ জন শ্রমিকের বিপরীতে ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৩৩ টাকা।

নিয়ম অনুযায়ী এ প্রকল্পে সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে কাজ করেন শ্রমিকেরা। প্রত্যেক শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা। একজন শ্রমিক ৪০ দিন কাজ করতে পারেন। মোট ৪০ দিনে একজন শ্রমিক মজুরি পান ৮ হাজার টাকা। এই কর্মসূচির শ্রমিক দিয়ে গ্রামগঞ্জের বিধ্বস্ত রাস্তাঘাটে মাটি কেটে চলাচলের উপযোগী করার কথা। নীতিমালা অনুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল।

জুনের শেষের দিকে ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের দুটি প্রকল্প ঘুরে মাটির কাজের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাজে তেলকুপি গ্রামের হাসমতের বাড়ি থেকে মিলনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার দেখানো হলেও এখানে কোনো মাটি ফেলা হয়নি। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য হাসমত আলী বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে শুরু হওয়া রাস্তাটি সংস্কার দেখানো হয়। কিন্তু আমি এখানে এক কোদাল মাটি ফেলতে দেখিনি।’ একই গ্রামের মিলন মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার শেষ সীমানা দেখানো হয়। কিন্তু কোনো মাটির কাজ হয়নি। হলে আমরা মাটি কাটতে দেখতাম।’ এই প্রকল্পের সভাপতি ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আফসার উদ্দিন তখন বলেন, অনেক শ্রমিক ঢাকায় কাজে গেছেন। তাই শ্রমিক-সংকটের কারণে ওই রাস্তায় মাটির কাজ করা হয়নি। ২৯ জুন চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক দিয়ে সংস্কার কাজ করা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তেলকুপি গ্রামের এক শ্রমিক অভিযোগ করেন, ‘মাটির কাজ কী করব। মোট ৪০ দিন কাজ করে টাকা পাব ৮ হাজার। এর মধ্যে ৪ হাজার টাকা ইউপি সদস্যকে ঘুষ দিয়ে কাজ নিয়েছি। তাই মাটির কাজ না করে অন্যত্র দিনমজুরের কাজ করছি।’ একই গ্রামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘ইউপি সদস্য ওই রাস্তার মাটির কাজের কথা বলেছেন, কিন্তু কেন কাজ করব। টাকা দিয়ে কাজ নিয়েছি। পুরো দিন কাজ করলে আমাদের লোকসান হবে। তাই করিনি।’ এ প্রসঙ্গে ইউপি সদস্য আফসার উদ্দিন বলেন, ‘শ্রমিকদের তালিকা আমরা করিনি। এটা অনেক আগের তালিকা। ফলে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

একই ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মনোহরপুর জহুরুলের বাড়ি থেকে হারানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি মেরামত দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই রাস্তায় কোনো মাটির কাজ হয়নি। মনোহরপুর গ্রামের কলেজছাত্র মিল্লাত হোসাইন বলেন, ‘এই গ্রামেই আমার বাড়ি। এই রাস্তায় মাটি ফেলার কোনো নমুনা নেই।’ এই প্রকল্পের সভাপতি ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এনায়েত আলী দাবি করেন, ওই রাস্তায় মাটি ফেলা হয়েছে।

এদিকে এই ওয়ার্ডেও টাকা নিয়ে শ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোহরপুর গ্রামের এক শ্রমিক অভিযোগ করেন, ‘প্রত্যেক শ্রমিকের কাছে থেকে তিন-চার হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে নাম তালিকায় তোলা হয়েছে। আমার কাছ থেকেও তিন হাজার টাকা ঘুষ নেন ইউপি সদস্য।’ তিনি বলেন, টাকা নিয়ে শ্রমিক নিলে তাঁরা কাজ করবেন কেন। কাজ করলে তো তাঁদের পোষাবে না। তাই বেশির ভাগ শ্রমিক ৪০ দিনের কাজ করতে চান না। এ প্রসঙ্গে ইউপি সদস্য এনায়েত আলী বলেন, ‘আমার পূর্ববর্তী মেম্বরের আমলে তালিকা হয়েছে। ফলে ঘুষ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জামিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দক্ষিণ দিকে মোনতাজের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত করার কথা। কিন্তু রাস্তার কিছু জায়গায় যেনতেনভাবে মাটি ফেলা হয়েছে। জামিরা গ্রামের ব্যবসায়ী মজিবর রহমান বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। কিন্তু এই রাস্তায় কখনো মাটি ফেলতে দেখিনি।’ এই প্রকল্পের সভাপতি ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, ওই রাস্তায় মাটি ফেলা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিশ আলী বলেন, ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির কাজে অনিয়ম এবং ঘুষ নিয়ে শ্রমিক নিয়োগের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।’