এইচআইভি প্রতিরোধে জনসচেতনতা জরুরি

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। পাশে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী রেজা খান। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। পাশে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী রেজা খান। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশের নিচে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার প্রায় ৪ শতাংশ। তবে ঢাকা শহরে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ।

গতকাল বুধবার সকালে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘এইচআইভি-এইডস এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধে সামাজিক সচেতনতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এই তথ্য দেন।

সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি) ও ইউএসএআইডির সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো।

এতে আলোচকেরা বলেন, এইচআইভিতে আক্রান্তের ৮৪ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ শিরায় মাদক গ্রহণের কারণে এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে নারী যৌনকর্মী, হিজড়া ও সমকামীর তুলনায় শিরায় মাদক গ্রহণকারীরা অনেক গুণ বেশি ঝুঁকিতে। তবে অভিবাসী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এইচআইভিতে সংক্রমণের হারও বেশি।

অধিদপ্তর থেকে প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ কনডম বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয় বলে জানান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশুস্বাস্থ্য) মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে এইচআইভি স্ক্রিনিং করা গেলে এ ধরনের রোগ শনাক্ত ও তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা সহজ হতো।

আলোচকেরা বলেন, দেশে ১০টি যৌনপল্লি আছে। অথচ গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ৫০ শতাংশ নারী যৌনকর্মী কনডম ব্যবহার করেন। যাঁদের মধ্যে ধারাবাহিক কনডম ব্যবহারের হার মাত্র ২১ শতাংশ। অথচ যৌনকর্মীদের ৬৪ শতাংশ গত এক বছরে এক বা একাধিকবার যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। একই রকম তথ্য পাওয়া যায় সমকামী ও হিজড়াদের সম্পর্কে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রামের চিফ অব পার্টি লিমা রহমান বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে কম মূল্যে কনডম সরবরাহের পাশাপাশি যৌনকর্মীদের এইচআইভির ঝুঁকি সম্পর্কে জানানো হয়। তবু সংক্রমণের দিক থকে তাঁরা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাঁদের জন্য আধুনিক ও আকর্ষণীয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রবর্তন করা দরকার।

এইচআইভিতে আক্রান্ত হলেও নারীরা মা হতে চান, উল্লেখ করে ইউএনএইডস বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সায়মা খান বলেন, আক্রান্ত মা থেকে সন্তানের এইচআইভিতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ১৫ থেকে ৪৫ শতাংশ। কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা নিলে সে ঝুঁকি ২ শতাংশে নেমে আসে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৮ লাখ মা গর্ভধারণ করেন, যাঁদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই অনাকাঙ্ক্ষিত বলে জানান ইউএনএফপিএর কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণে মা ও শিশু উভয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। এসব মা পারিবারিক নির্যাতনের শিকারও হন বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. বেলাল হোসেন বলেন, পৃথিবীব্যাপী এইচআইভি সংক্রমণের বড় কারণ অনিরাপদ যৌন অভ্যাস।

এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়নি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ বিল্‌লাল হোসেন বলেন, ১৯৮৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাত্র ৩৭ শতাংশ পরীক্ষা করিয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার পরও অনেকে বিষয়টি পরিবারকে জানান না। এতে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়ে।

কনডম ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে ইউএসএআইডির কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ সামিনা চৌধুরী বলেন, যৌনমিলন বাদে অন্য যেসব উপায়ে এইচআইভিতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে, সেগুলো সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীদের সচেতন করা এবং সেবার আওতায় আনা জরুরি উল্লেখ করে আইসিডিডিআরবির প্রোগ্রাম ফর এইচআইভি অ্যান্ড এইডসের প্রকল্প সমন্বয়ক এ কে এম মাসুদ রানা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এইচআইভি ঠেকাতে দেশের ১১টি হাসপাতালে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানে রোগী আসছে না। ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে এইচআইভি সম্পর্কে জানানো হয়। কিন্তু ফেরত আসার পর কী হয়, তা জানা যাচ্ছে না।

মাদকাসক্তদের মধ্যে কনডম সরবরাহ করা হলেও তাঁরা তেমন ব্যবহার করেন না বলে উল্লেখ করেন মুক্ত আকাশ বাংলাদেশের উপপরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বড় একটি অংশ ভাসমান বলে পর্যবেক্ষণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

এসএমসির হেড অব বিহেভিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশন মহিউদ্দিন আহমেদ কমিউনিটি রেডিও এবং স্থানীয় কেবল সংযোগের মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতন করার পরামর্শ দেন।


অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম