আয়শার জামিন হয়নি, আবেদন ফেরত নিলেন তাঁর আইনজীবীরা

আয়শা সিদ্দিকা। ফাইল ছবি
আয়শা সিদ্দিকা। ফাইল ছবি

বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন হয়নি। বরগুনার আদালতে দুই দফা বিফল হয়ে হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন আয়শা। এই আবেদনের ওপর আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানি নিয়ে আদালত রুল (জামিন প্রশ্নে) দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এ প্রেক্ষাপটে আয়শার আইনজীবীরা জামিন আবেদন ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে তা ফেরত নেন।

শুনানির শেষ পর্যায়ে আয়শার আইনজীবীর উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, ‘আমরা রুল দিতে চাচ্ছি, আপনার ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নিয়ে আসেন। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দেখে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত দেব? যদি রুল না নেন, তাহলে টেক ব্যাক (ফেরত নেন) করতে পারেন।’ পরে আয়শার আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আবেদন (জামিন) ফেরত নিচ্ছি।

জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ আগস্টের পর হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চে জামিন আবেদনটি উপস্থাপন করা হবে। আয়শাসহ অন্যদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি পেতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ওই মামলায় গত ২১ জুলাই প্রথমে বিচারিক হাকিম আদালতে এবং পরে গত ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন চেয়ে বিফল হন আয়শা। এ অবস্থায় গত ৪ আগস্ট আয়শার জামিন চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি করা হয়, যার ওপর আজ শুনানি হয়। বিকেল তিনটা থেকে সোয়া চারটা পর্যন্ত শুনানি চলে।

আদালতে আয়শার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম মঈনুল ইসলাম, মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম গোলাম মোস্তফা ও মো. রেজাউল করিম।

শুনানির শুরুতে জামিনের আরজি জানিয়ে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ঘটনার তারিখ ২৬ জুন, এজাহার হয় ২৭ জুন। এজাহারে আয়শা এক নম্বর সাক্ষী। একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী। এক আসামির বক্তব্যের ভিত্তিতে ১৬ জুলাই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়, পরদিন গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বেআইনি, ভুলভাবে ও জোরপূর্বক তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়, যা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন। মেয়েটির বয়স ১৯ বছর। এ ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা নেই, থাকলে জীবন বাজি রেখে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন না। মেয়েটি আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এ ছাড়া অসুস্থও। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুসারে বৃদ্ধ, নারী ও অসুস্থ ব্যক্তি জামিন পেতে পারেন, সে অনুসারে শুধু জামিন চাচ্ছি।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির পুলিশের প্রতিবেদন ও বরগুনার আদালতে আয়শার জামিন নামঞ্জুর হওয়ার দুটি আদেশ পড়ে শোনান।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ও ৪৯৮ ধারা তুলে ধরে মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, চারজনের জবানবন্দিতে তাঁর (আয়শার) নাম এসেছে। উভয় পক্ষের নিজ নিজ দাবি করা ভিডিও ফুটেজ, ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, ঘটনার আগে পরে আয়শার সঙ্গে নয়ন বন্ডের ফোনে কথোপকথন, নয়নের সঙ্গে আয়শার বিয়ের কাবিননামা ও সিডি বিবেচনায় নিয়ে দায়রা আদালত আয়শার জামিন আবেদন খারিজ করেছেন। অভিযোগের সারবত্তা প্রতীয়মান হয় বলেও আদেশে এসেছে।

পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, আয়শা প্রকৃতপক্ষে রিফাত হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা (মাস্টারমাইন্ড)। ঘটনার আগে ও পরে আয়শার সঙ্গে নয়ন বন্ডের কথা হয়েছে। আপিল বিভাগের নির্দেশনা মেনেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁকে রিমান্ডে দুই দিন রাখা হয়, পাঁচ দিন নয়। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুসরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আবেদনকারী অসুস্থ, সে বিষয়ে কোনো তথ্য তাঁরা আদালতে দেননি।

শুনানির এই পর্যায়ে জেড আই খান পান্না বলেন, উনি পুলিশের কথা বলেছেন। এখন পর্যন্ত মামলার অপর চার আসামিকে ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের যে উদ্যোগ নেই, এটি পরিষ্কার। এটি জামিনের বিষয়।

আইনজীবীর উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, ‘আপনার (আয়শা) ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কি আপনার কাছে আছে?’ তখন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘পাইনি, চেষ্টা করেছি। যেহেতু চার্জশিট দেয়নি, সে কারণে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি আমাদের দেয়নি।’ আদালত বলেন, ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দেখে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত দেব?’ তখন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘যদি অভিযুক্ত হই, তাহলে আমার বিচার হবে। আমার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই।’ আদালত বলেন, ‘আমরা রুল দিয়ে দিচ্ছি, আপনি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নিয়ে আসেন। আপনার ১৬৪ ধারার জবানবন্দি আছে, ১৫ জনের মধ্যে আরও কজনের আছে।’

তখন আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘১৫ জনের মধ্যে শুধু দুজন আমার কথা বলছে। একটু বিবেচনা করুন। এফআইআরে আমার নাম নেই।’ আদালত বলেন, ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেখতে হবে।’ তখন আইনজীবী বলেন, ‘তাহলে এ বিষয়ে আদেশ দিয়ে দিন।’ আদালত বলেন, ‘রুল দিচ্ছি, যদি রুল না নেন, তাহলে টেক ব্যাক (ফেরত নেন) করতে পারেন।’ পরে আইনজীবী বলেন, ‘তাহলে আবেদনটি টেক ব্যাক করছি।’

গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। ওই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী তাঁকে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছেন। ঘটনার পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এরপর গত ২ জুলাই নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। পরে রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। গত ১৬ জুলাই আয়শাকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।