নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন করুন

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অসদাচরণের ব্যাপকভিত্তিক অভিযোগ, অভিযোগগুলোর অর্থবহ তদন্ত ও অপরাধীর জবাবদিহির অনুপস্থিতি, অঘোষিত আটক ও গুমের ঘটনাগুলোর বিষয়ে সরকারের তথ্য প্রকাশের ব্যর্থতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি (ক্যাট)। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর কমিটি যে উপসংহারে পৌঁছেছে, তাতে এসব বিষয় ছাড়াও ২০টি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ৩০ ও ৩১ জুলাই এ পর্যালোচনা সভা জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়।

গতকাল শুক্রবার জেনেভায় প্রকাশিত কমিটির চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে এসব বিষয়ে সরকারের কাছে অন্তত ৭৭টি সুপারিশ করা হয়েছে। সনদ স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে ২০ বছর সময় লাগায় কমিটি দুঃখ প্রকাশ করে। তবে কমিটির সভায় বিভিন্ন জিজ্ঞাসার মৌখিক ও লিখিত জবাব দেওয়ার বিষয়টিকে গঠনমূলক অভিহিত করে কমিটি তাকে স্বাগত জানিয়েছে।

কমিটি তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী বছরের ৯ আগস্টের মধ্যে এসব বিষয়ে অগ্রগতি জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিষয়গুলো হচ্ছে এক. হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলোর হাইকোর্টের নির্দেশনা পুরোপুরি অনুসরণ নিশ্চিত করা। দুই. আটক রাখার স্থানগুলো স্বাধীন কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি সংগঠন বা এনজিও প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নির্বিচার আটক ব্যক্তিদের অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। তিন. যেসব এনজিও কমিটিকে সহযোগিতা করেছে, তাদের হয়রানি ও প্রতিশোধ থেকে সুরক্ষা দেওয়া।

কমিটি তার পর্যবেক্ষণের শুরুতেই মানবাধিকারবিষয়ক অনেক সনদ ও প্রটোকল স্বাক্ষর বা অনুমোদনের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক সনদ, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য অবসানের বর্ধিত সনদ, শিশু অধিকারবিষয়ক একাধিক সনদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতবিষয়ক রোম স্ট্যাটিউট ইত্যাদি।

কমিটি একই সঙ্গে হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যা নিবারণ আইন, ২০১৩; নারী ও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিকার আইন; আইনি সহায়তাবিষয়ক আইন; মানব পাচার প্রতিকারবিষয়ক আইন; পারিবারিক সহিংসতা আইনসহ মোট আটটি আইন সংস্কার বা সংশোধনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকেও স্বাগত জানিয়েছে।

রাষ্ট্র যুদ্ধাবস্থায় আছে বা যুদ্ধের হুমকির মুখে আছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা অন্য কোনো জরুরি পরিস্থিতিকে নির্যাতনের যৌক্তিকতা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না বলে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদের ধারা ২ স্মরণ করিয়ে দিয়ে কমিটি বলেছে, স্বীকারোক্তি আদায় অথবা ঘুষ নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যে বিপুলসংখ্যক অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে কমিটি উদ্বিগ্ন। নির্যাতন ও নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণকে নিষিদ্ধ করার সাংবিধানিক বিধান, ২০১৩ সালের নির্যাতন প্রতিরোধ আইন এবং সরকারের জিরো টলারেন্সের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও কমিটির প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

নির্যাতনবিষয়ক সাতটি সুপারিশের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতন এবং অসদাচরণের বিষয়টিকে জরুরি উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে এটা স্বীকার করে নিয়ে কোনো অবস্থাতেই তা সহ্য করা হবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত রয়েছে, তার বাইরেও রাষ্ট্রের অন্য যেকোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিধানটি কার্যকর করা এবং নির্যাতনের জন্য তার ব্যক্তিগতভাবে অপরাধের দায় বহন নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও এতে বলা হয়েছে। এতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বদলে অপরাধ তদন্তে বৈজ্ঞানিক বা ফরেনসিকস অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কমিটি হেফাজতে নেওয়া স্বীকারোক্তিকে আইনগতভাবে গ্রহণ না করার কথাও বলেছে।

নির্যাতনের অভিযোগ যথাযথ বা পর্যাপ্তভাবে তদন্ত না হওয়ার বিষয়টিতে কমিটি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নির্যাতন ও গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের অভিযোগ গ্রহণে পুলিশ প্রায়ই অস্বীকৃতি জানায় বলে প্রকাশিত খবরগুলোয় উদ্বেগ প্রকাশ করে কমিটি বলেছে, তারা আরও বেশি উদ্বিগ্ন যে অভিযোগকারী পরিবারগুলোকে পরে হুমকি, হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের শিকার হতে হয়। ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে ৭৭টি নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‍শুধু আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ছাড়া আর কোনো অভিযোগের বিষয়ে সরকার তথ্য দেয়নি বলে কমিটি হতাশা প্রকাশ করেছে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শহিদুল আলমের শরীরে বড় কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলায় তাঁকে নির্যাতনের অভিযোগের তদন্ত বন্ধ করে দেওয়ায় কমিটি দুঃখ প্রকাশ করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে সরকার যেসব তথ্য দিয়েছে, তাতে সবচেয়ে গুরুতর শাস্তি চাকরিচ্যুতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পদাবনতিকে গুরুতর অপরাধের জন্য প্রাপ্য সাজার উপযুক্ত নয় বলে কমিটি মন্তব্য করেছে। কমিটি এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা, নির্যাতনের শিকার এবং সাক্ষীদের কার্যকর সুরক্ষা দিতে দ্রুত আইন প্রণয়ন, নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে সময় বেঁধে দেওয়া এবং নির্যাতনের অভিযোগে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও ইস্তাম্বুল প্রটোকল অনুযায়ী নির্দেশনা অনুসরণের সুপারিশ করেছে।

অঘোষিত আটক, যাকে কমিটি আনঅ্যাকনলেজড ডিটেনশন বা অন্তর্ধান হিসেবে বর্ণনা করেছে, সেই বিষয়টিতে কমিটি বলেছে, এ রকম ব্যক্তিকে হত্যা করা হোক অথবা তিনি আবার ফিরে আসুন—যেটাই হোক না কেন, তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অহরহই গুমের ঘটনা ঘটছে এমন বক্তব্যকে সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করে এগুলোকে ভুয়া বা মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। একমাত্র নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাকে সরকারের প্রতিনিধিদল স্বীকার করে নিলেও কক্সবাজারের একরামুল হক, সাতক্ষীরার শেখ মোখলেসুর রহমানসহ অন্য অভিযোগগুলো তদন্ত করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে সরকার কোনো তথ্য দেয়নি উল্লেখ করে কমিটি হতাশা প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের গুমবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশে গুমের ঘটনা অনেক ঘন ঘন ঘটছে বলে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সে বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটি র‌্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তার, অঘোষিত আটক, গুম এবং তাদের হেফাজতে থাকাকালে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটিকে ব্যতিক্রম অভিহিত করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এ ধরনের আইন লঙ্ঘনের জন্য র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি তদন্ত ও বিচার হয়নি। কমিটি বলেছে, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর আইন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অ্যাক্টের ১৩ নম্বর ধারায় যে সরল বিশ্বাসের বিধান রয়েছে, তা কার্যত বাহিনীগুলোকে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দিয়েছে।

র‌্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন এবং তদন্তকারীদের হয়রানি ও হুমকি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে ক্যাটের সুপারিশে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য র‌্যাবে প্রেষণে পাঠানোর চর্চা বন্ধেরও সুপারিশ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া বা রিমান্ডের ক্রমবর্ধমান চর্চার বিষয়েও কমিটি উদ্বেগ জানিয়েছে।

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর সহিংসতার বিষয়ে কমিটি স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে। ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পুলিশ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরের অন্য কারও সহিংসতার ঘটনাগুলোও তদন্ত এবং বিচারের কথা এ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিষয়ে সরকারি প্রতিনিধিদলের ব্যাখ্যায় দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করলেও কমিটি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের জন্য তাঁকে হয়রানি ও দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করার জন্য মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনায় কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিটির পর্যালোচনা সভায় আইনমন্ত্রী এ ধরনের কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার যে অঙ্গীকার করেছেন, তাকে স্বাগত জানিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং বিদেশি অনুদান আইনগুলোর রাষ্ট্রবিরোধী ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের মতো বিধানগুলো বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

নির্যাতনবিরোধী সনদের অপশনাল প্রটোকল অনুমোদন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীন নয়জন বিশেষজ্ঞ বা স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারকে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানানোরও অনুরোধ জানিয়েছে কমিটি।