কিছু উপজেলায় ডেঙ্গু শনাক্তের উপকরণ নেই

ঈদের পরে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। সরকারি কর্মকর্তারা দেশবাসীকে ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে ও ছুটি থেকে ফেরার পর বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে দেশের সব উপজেলা সরকারি হাসপাতালে তাঁরা ডেঙ্গু শনাক্তকরণ উপকরণের (কিট) প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি। 

ঈদের ছুটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের সব জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। জেলাগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা থেকে সারা দেশে মানুষ যাওয়ার কারণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে গতকাল পর্যন্ত দেশের সব সরকারি উপজেলা হাসপাতাল ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট সংগ্রহ করেনি বা কেনেনি। প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধিরা কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, সিলেট, পাবনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও রংপুর জেলার উপজেলা হাসপাতালগুলোয় যোগাযোগ করে এই তথ্য পেয়েছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য তাঁরা ২ লাখ করে টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। 

খুলনা জেলার রূপসা, ফুলতলা, ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা উপজেলা হাসপাতালে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো কিট ছিল না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেরা কেনেননি বা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করেননি। রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিট আনার প্রক্রিয়া চলছে। কেনার জন্য টেন্ডার কমিটি করা হয়েছে। হয়তো ঈদের পরে পেয়ে যাব।’ অন্য তিন উপজেলার কর্মকর্তারা একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এই জেলার দাকোপ, তেরখাদা, ডুমুরিয়া, কয়রা ও দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে কিট কিনেছেন বা সংগ্রহ করেছেন। 

রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলা হাসপাতালের প্রতিটি ২ লাখ করে টাকা পেয়েছে। কিন্তু একটি হাসপাতালেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো কিট কেনা হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালকে ১০ লাখ ও উপজেলা হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা করে বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। এই টাকায় ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণ কিনতে বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা পাওয়ার পরও অনেক উপজেলায় তা কেনা হয়নি। 

পাবনা জেলায় উপজেলা হাসপাতাল ৯টি। এর মধ্যে চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ঈশ্বরদী, বেড়া, আটঘরিয়া ও সাঁথিয়া উপজেলা হাসপাতালে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো কিট ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। চাটমোহর উপজেলা কমপ্লেক্সের চিকিৎসক বায়েজিদ উল ইসলাম বলেন, ‘এ পর্যন্ত দু–একজন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে এসেছেন। বাইরে থেকে তাঁদের পরীক্ষা করা হয়েছে।’ এদিকে ফরিদপুর জেলার সদরপুর, নগরকান্দা, চরভদ্রাসন ও আলফাডাঙ্গা উপজেলা হাসপাতালে কিট ছিল না। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক সিভিল সার্জনকে সুস্পষ্ট করে বলেছি সংশ্লিষ্ট উপজেলায় যেন কিট থাকে। প্রয়োজনের সময় মানুষ যেন পরীক্ষা করাতে পারেন। আজ (শনিবার) এসএমএসের মাধ্যমে এই নির্দেশনা আমি সারা দেশে পাঠাব।’

এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কিটের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবসায়ীদের কিট আমদানির ব্যাপারে বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। অধিদপ্তর সারা দেশে কিট সরবরাহের তথ্যও সমন্বয় করছে। একটি হটলাইনও তারা খুলেছে। ০১৭০৮৫০৬০৪৭ নম্বরে ফোন করে কিটের ব্যাপারে সব ধরনের পরামর্শ পাওয়া যাবে। 

তবে সরকারি কর্মকর্তারা ছুটিতে যাওয়ার আগে ও ছুটি থেকে ফেরার পর ঢাকাবাসীকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছুটিতে যাওয়ার আগে বাসার কোনো জায়গায় বা পাত্রে পানি যেন না জমে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাত্র উল্টে রাখতে হবে। কমোড ঢেকে যেতে হবে।’

ঈদের সময় প্রায় ১ কোটি মানুষ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ছেড়ে যাবে। তবে ইতিমধ্যে যাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, তাদের ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘কিছু ডেঙ্গু রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে পারে। দীর্ঘ পথযাত্রায় ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার ঝুঁকি আছে। তা ছাড়া ঢাকায় আইসিইউ সেবাসহ অন্যান্য উন্নত সেবার যে সুযোগ আছে, গ্রামে বা উপজেলায় তা পাওয়া যাবে না। তাই অনুরোধ জানাব, কোনো রোগী যেন ঢাকা ছেড়ে না যান।’ 

ছুটি শেষে বাসায় ঢোকার আগেও বিশেষ সতর্কতার কথা বলেছেন আইইডিসিআরের পরিচালক। তিনি বলেন, শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীরা বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। শুরুতে এরা ঘরে ঢুকবে না। পরিবারের সবচেয়ে সবল ব্যক্তি হাত–পা ঢাকা জামাকাপড় পরে ঘরে ঢুকে স্প্রে করবেন। আধা ঘণ্টা পরে ঘরের সব জানালা–দরজা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিতে হবে। কমোড ফ্ল্যাশ করতে হবে। কোথাও পানি জমলে তা ফেলে দিতে হবে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা গত তিন দিনের হাসপাতালে রোগী ভর্তির পরিসংখ্যা তুলে ধরে বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী কমে যাওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ আছে। যেমন: মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে, অনেকে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, বহু মানুষ ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছাড়ছেন, অনেকে ছুটিতে হাসপাতালে থাকতে চান না।

অন্যদিকে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতাবস্থার মতো। কমেছে বা কমছে, এটা বলার সময় আসেনি।’ তিনি বলেন, কড়া রোদ বা মুষলধারে বৃষ্টি হলে এডিস মশা কমবে এবং তাতে ডেঙ্গু সংক্রমণেও ভাটা পড়বে।